ডেস্ক রিপোর্ট : চাকরি দাবিকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অবরোধ থেকে ১৩ ঘণ্টা পর মুক্ত হয়ে আলোচনায় আসা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এ কে এম নূর-উন নবীর বিরুদ্ধে অর্থ নয়-ছয় করাসহ অনেক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুক্রবারই উপাচার্যের মেয়াদ শেষ করা অধ্যাপক নূর-উন নবীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে অতিরিক্ত আপ্যায়ন খরচ, ভর্তি পরীক্ষার সম্মানি হিসেবে ‘অনৈতিকভাবে’ বিপুল অংকের অর্থগ্রহণ এবং একটির জায়গায় ঢাকা ও রংপুরে তিনটি গাড়ি ব্যবহারের তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া তিনি কোষাধাক্ষ্যসহ একাই ১৪ পদ আকড়ে থেকে ‘অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন’ এমন ১৬টি প্রসঙ্গ উঠে আসে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে।তবে এসব বিষয়ে নিজের দোষ অস্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের এই অধ্যাপক বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি পক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে ‘পক্ষপাতমূলক’ ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরিতে তার সঙ্গে ‘সময় নিয়ে কথা বলে’ অনুসন্ধানের কাজ করা হয়নি।
তিনি শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারাতো তদন্ত করেনি। একদল লোকের মনমতো রিপোর্ট লিখে দিয়েছে। এই রিপোর্টের কোনো গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে আমি মনে করি না। আমাকে যথাযথভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটা কী রিপোর্ট?”দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগের দাবির মুখে আগের উপাচার্য আব্দুল জলিল মিয়াকে সরিয়ে অধ্যাপক নূর-উন নবীকে ২০১৩ সালের ৬ মে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেয় সরকার।তার চার বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার দুদিন আগে বুধবার সকালে উপাচার্যকে অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। উপাচার্য তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে কথা রাখেননি বলে দাবি করেন তারা। দিনভর অবরুদ্ধ থাকার পর মধ্যরাত সাড়ে ১২টায় তাকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এই ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে ইউজিসির ওই তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য গণমাধ্যমে আসে। প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে ইউজিসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।২০১৬ সালের ৬ মার্চ ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দেখতে গেলে তখনকার শিক্ষক সমিতির সভাপতি আরএম হাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাবিউর রহমান প্রধান উপাচার্যের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন।এরপর ২ আগস্ট ইউজিসির সদস্য আখতার হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি; যার প্রতিবেদন গত ২২ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়।
‘অতিরিক্ত’ আপ্যায়ন খরচ
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উপাচার্য ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ এই দুই অর্থবছরে ক্যাম্পাসে ১৬৫ দিন অবস্থান করে নয় লাখ ৭৪ হাজার ৪৯৫ টাকা আপ্যায়ন বাবদ ব্যয় করেছেন, যা অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়।এছাড়া উক্ত সময়ে কোষাধ্যক্ষ হিসাবে আপ্যায়ন বাবদ খরচ করা ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৩ টাকা খরচকে ‘অনৈতিক’ হিসাবে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।সেই হিসাবে দুই দপ্তরে অধ্যাপক নূর-উন নবীর আপ্যায়ন বাবদ খরচ হয়েছে মোট ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২৮ টাকা; যা গড়ে প্রতিদিন সাত হাজার ২৩৩ টাকায় দাঁড়ায়।প্রতিবেদনে তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উপাচার্য দপ্তর এবং কোষাধ্যক্ষ দপ্তরের আপ্যায়ন হিসাবে হিসাব বিভাগ থেকে তথ্য প্রাপ্তির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে ওই দুই দপ্তরের আপ্যায়ন বরাদ্দ খরচ হতে পারে কি-না সেই বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান আখতার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিধি অনুযায়ী যারা আপ্যায়ন ব্যয়ের জন্য এনটাইটেল তারাই করতে পারবেন।”উপাচার্য না থাকলেও তার দপ্তরগুলো আপ্যায়ন ব্যয় করতে পারেন কি-না, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে যারা থাকেন, বিধি অনুযায়ী তাদের জন্য একটা বরাদ্দ থাকে। যারা দায়িত্বে থাকবেন তারাই খরচ করবেন।”এতো বড় অঙ্কের আপ্যায়ন ব্যয়ের বিষয়ে অধ্যাপক নূর-উন নবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপ্যায়ন ব্যয় নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কিন্তু ইউজিসির অডিটতো এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। দেখা যায়, ২০ জনের একটা সদস্য নিয়ে একটা মিটিং করবেন, কিন্তু সেখানে অ্যাকাউন্টস, রেজিস্ট্রি অফিস, সংস্থাপন ও উপাচার্য অফিসসহ ৬০-৬৫ জন, তাদের জন্য গড়ে সাত হাজার টাকা ব্যয়তো ‘কোয়াইট নরমাল’।”অডিট সম্পর্কে উপাচার্য যে দাবি করেছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি ইউজিসি তদন্ত কমিটির প্রধান আখতার হোসেন।
উন্নয়ন ফান্ডের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন
ভর্তি পরীক্ষার সম্মানী হিসাবে উপাচার্য নূর-উন নবী প্রথম তিন বছরে ১৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন উল্লেখ করে এই ‘বিপুল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ অনৈতিক’ ও ‘আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে’ বলে উল্লেখ করা হয় ইউজিসি’র তদন্ত প্রতিবেদনে।ওই অর্থ ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন’ শীর্ষক ফান্ডে জমা করার বিষয়ে উপাচার্য তদন্ত কমিটিকে জানান উল্লেখ করে এতে বলা হয়, “ভর্তি পরীক্ষার সম্মানি বাবদ গৃহীত অর্থ তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন শীর্ষক একটি ফান্ডে জমা করেছেন এ স্ব-পক্ষে কোনো ডকুমেন্ট তিনি সরবরাহ করতে সক্ষম হননি।”বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে নিয়োগের দাবিতে গত বুধবার ১৩ ঘণ্টা উপাচার্য নূর-উন নবীকে অবরুদ্ধ করে রাখেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।এ ধরনের উন্নয়ন ফান্ড গঠনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির ও সিন্ডিকেটের অনুমোদনের কোনো ‘প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি’ বলেও উল্লেখ করা হয় ইউজিসি’র প্রতিবেদনে।
অধ্যাপক নূর-উন নবী এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিটি আমার কাছে কিছু চায়নি। কমিটি যদি আমার কাছে অভিযোগটা দিত, তাহলে আমি প্রত্যেকটা বিষয় দালিলিক প্রমাণ দিয়ে তাদের দেখাতাম।“তারা সময় নিয়ে আসুক না… আমি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ব্যাংকের হিসাব তাদের দেখাই? এটা কোন ফিন্যান্স কমিটি ও কোন সিন্ডিকেটে পাস হয়েছে আমি তাদেরকে দেখাই, আসুক না। অসুবিধা কি? তারা সেটা দেখতে আসেনি। তারা একদিন আধা ঘণ্টার জন্য এসেছিল, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বিষয় জানতে চেয়ে চলে গিয়েছিল।”
সরকারি গাড়ি ব্যবহারে ‘স্বেচ্ছাচারিতা’
উপাচার্য নূর-উন নবীর বিরুদ্ধে সরকারি গাড়ি ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারিতার যে অভিযোগ শিক্ষকরা করেছেন সে বিষয়ে প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি।প্রতিবেদনে বলা হয়, “উপাচার্য রংপুরে দুটি গাড়ি ও ঢাকায় একটি গাড়ি ব্যবহার করেন। প্রাধিকার অনুযায়ী তিনি একটি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। ঢাকায় ব্যক্তিগত বাসায় রক্ষিত গাড়িতে মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগানো রয়েছে। গাড়ির জ্বালানি খরচসহ অন্যান্য ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদান করা হয়।”এতে আরও বলা হয়, “উপাচার্য মহোদয় কমিটিকে অবহিত করেন যে, স্টিকার লাগানো গাড়ি দিয়ে মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন অফিস/প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করা সহজ হয় বিধায় গাড়িটি ঢাকায় রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষিত দুটি গাড়ির একটি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন বা রেজিস্ট্রার বা সিনিয়র শিক্ষকদের ব্যবহার করতে দেয়া হয় না- এ প্রসঙ্গে তিনি অবহিত করেন যে, এই গাড়ি ব্যবহার করার মতো কোনো যোগ্য বা প্রাধিকার প্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা এই মুহূর্তে নেই।”
তিনটি গাড়ি ব্যবহারকে ‘বিলাসিতা’ আখ্যায়িত করে তদন্ত প্রতিবেদনে উপাচার্য নূর-উন নবীর এসব বক্তব্যকে ‘যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলেই থাকা সমীচীন। ঢাকায় রক্ষিত গাড়িটি উপাচার্য মহোদয়ের স্ত্রী ব্যবহার করেন, যা অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সম্পদের সুরক্ষা প্রদান করবেন, কিন্তু তিনি এহেন সম্পদের অপব্যবহার করেছেন।”গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে অধ্যাপক নূর-উন নবী তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যের অনেকটা পুনরাবৃত্তি করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে।
তিনি বলেন, “পুরোনো গাড়িটা ঢাকায় ছিল এজন্য যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া যে পাস, যেটার মাধ্যমে উপাচার্য সচিবালয়ে ঢুকতে পারেন। ওই পাসটা ছিল বলেই আমার গাড়িটা রাখতে হয়েছে। কারণ আমি যদি পাসটা খুলে আবার নতুন গাড়িতে লাগাই তাহলে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। কারণ ওই পাসের সঙ্গে আমার ওই গাড়ির নম্বর দেওয়া আছে। সেটা চলবে না। এবং সে কারণে ওই গাড়িটা ছিল।”অধ্যাপক নূর-উন নবীর বিরুদ্ধে কৌশলে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট বন্ধ রাখা, নিয়োগ বাণিজ্য, তার বিরোধী শিক্ষক-কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে নূর-উন নবীর অভিযোগ নাকচ করে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু ওনার বিরুদ্ধে রিপোর্ট ওনার ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক।
“উনি কী বলেছেন, কী বলেননি সেটা এখন বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা কমিটি করেছি। সেখানে আমাদের একজন সদস্য ছিলেন, আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য ছিলেন এবং আমাদের একজন অফিসার ছিল- তারা কী দিয়েছে সেটা বিবেচ্য বিষয়। তিনি কী বলেছেন? তারা কী চেয়েছেন, কী চান নাই- সেটা এখন বলাতো নিরর্থক।“ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, “তদন্ত কমিটি হয়েছে অনেক আগে, আমরা গত মাসের শেষের দিকে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এই পর্যায়ে আমাদের আর কিছু করার নেই। আমাদের কাছে যে অভিযোগগুলো এসেছিল সেটার সত্যাসত্য অনুসন্ধান আমরা করেছি। মন্ত্রণালয় থেকে এখন তাদের মতো করে পদক্ষেপ নেবে।”
আগের উপাচার্য আব্দুল জলিল মিয়ার ক্ষেত্রেও এরকম হয়েছিল জানিয়ে অধ্যাপক মান্নান বলেন, “আগের ভিসির আমলে আমরা একটা তদন্ত করেছিলাম। ওনার পছন্দ হয় নাই, উনি প্রতিবাদ করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবার আমাকে প্রধান করে আরেকটা কমিটি করেছিল।“আমরা পরে তদন্ত করে দেখেছি, আগে যে তদন্ত রিপোর্ট হয়েছিল সেটার সঙ্গে আমাদের অনুসন্ধানে কোনো গরমিল পাওয়া যায়নি। এবারও আমাদের কাজ আমরা করেছি। এখন মন্ত্রণালয় দেখবে, তারা কী করবে।”
বি/নি/2