untitled-314_20267

বিডি নীয়ালা নিউজ(২১জানুয়ারি১৬)- কৃষি প্রতিবেদনঃ দেশের বৃহত্তম শিম উৎপাদন এলাকা পাবনার মুলাডুলী ও আশপাশের এলাকায় শিম উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার আশংকাজনক হারে বেড়েছে। আবাদের প্রতিটি পর্যায়ে এবং গাছ থেকে শিম তোলার আগে রাসয়নিক উপকরণের ব্যবহার দেখে সচেতন মানুষ শংকিত হয়ে পড়ছেন। চাষীরা এবং বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানীর কর্মকর্তরা শিম উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার অপরিহার্য বলে দাবী করলেও কৃষিবিদ, চিকিৎসক এবং সচেতন মানুষরা এসব রাসায়নিক এবং কীটনাশকের ব্যবহার মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন।

শিম সাগর

শীতের সুস্বাদু সবজি শিম উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে মুলাডুলী ও আশপাশের এলাকা। ঈশ্বরদীর মুলাডুলী ইউনিয়নের ফরিদপুর, মুলাডুলী, রামেশ্বরপুর, আটঘরিয়াপাড়া, মধ্যপাড়া, বেতবাড়ীয়া, কুমারগাড়ী, শেখ পাড়া, পাড়ামোহন, পতিরাজপুর, সোনাইকান্দি, আটঘরিয়া উপজেলার খিদিরপুর, পারখিদিরপুর, রামচন্দ্রপুর, রামেশ্বরপুর, গোকুলনগর, দরবেশপুর, সড়াবাড়ীয়া, বেরুয়ান, নসিরামপুর, কাকমাড়ীয়া, পাচালীপাড়া, লোকনপুর, কচিয়া, গোরুরী, শ্রীকান্তপুর, ধলেশ্বর, মুলাডুলীর পাশের নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার পুরো গোপালপুর ইউনিয়ন, চান্দাই, খৈরাস, গারফা, নগর ইউনিয়নের আংশিক, জোনাইল, গফুরাবাদ থেকে চাটমোহর পর্যন্ত বির্স্তীণ এলাকার মানুষদের স্বাবলম্বী হওয়ার দরজা খুলে দিয়েছে শিমের আবাদ। দেশের মোট শিম আবাদের প্রায় অর্ধেকটাই আসে এসব এলাকা থেকে। তাই এসব এলাকা পরিচিতি পেয়েছে ‘শিম সাগর’ নামে।

স্থানীয় কৃষক ও জমি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিমসাগর এলাকায় শিমের আবাদ হয় দুইভাবে। কেউ নিজের জমিতে আবাদ করে। আর যাদের নিজস্ব জমি নেই তারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করে। জমির অবস্থান ও আবাদ ক্ষমতা অনুযায়ী বিঘাপ্রতি জমির লিজ নেওয়া হয় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা। আলাপকালে মুলাডুলী মধ্যপাড়ার কৃষক দুলাল হোসেন, মোক্তার হোসেন, রেজাউল ইসলাম, সাহেব আলী জানান, একবিঘা জমি আবাদ করে ১০ থেকে ১২ মন শিম সংগ্রহ করা যায়। বিঘাপ্রতি জমিতে  আবাদে কমবেশী খরচ পড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে প্রতিবিঘার শিম বিক্রি করে নিট মুনাফা আসে কম বেশী ৪০ হাজার টাকার মত। শিম আবাদের সুবিধা হলো, দুই তিন দিন পরপরই গাছ থেকে পেড়ে তা বিক্রি করা যায়। ফলে শিম মৌসুমের পুরোটাই তারা বাজারজাত করতে পারে।

কমছে শিমের আবাদ

শিমসাগর এলাকার বাসিন্দারা আবাদ মৌসুমে তাদের জমিতে শিম ছাড়া অন্য কোন ফসল বা সবজি আবাদ করতেন না। গত এক বছরে হঠাৎ করেই এ চিত্র পাল্টে গেছে। পতিরাজপুর, রামেশ্বরপুর, পাশের আটঘরিয়া উপজেলার খিদিরপুরসহ আবাদ এলাকার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় চাষীরা শিমের সঙ্গে ঝিঙ্গা, কপি, বডবডি, বেগুনসহ অন্য ফসল ও সবজি আবাদ করছে। রামেশ্বরপুর গ্রামের চাষী রতন আলী তারা জানালেন, শিমের সঙ্গে অন্য ফসল আবাদ লাভজনক হওয়ায় এ বছর বেশীর ভাগ চাষী শিম আবাদ কমিয়ে তার সঙ্গে অন্য ফসলের আবাদ করছেন। শিম আবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী চাষিদের মধ্যে অন্যতম মুলাডুলি গ্রামের রাশেদুল ইসলাম জানান, গতবছর পর্যন্ত তিনি ৬০ বিঘা জমিতে শিমের আবাদ করেছেন। এ বছর ৩০ বিঘা জমিতে শিম আবাদ আর বাকি ৩০ বিঘায় কপি আবাদ করে অনেক বেশী লাভবান হয়েছেন।

মুলাডুলি হাটের আড়তদার সোহেল, আব্দুল খালেক জানান, শিম কেনাবেচায় দেশের বৃহত্তম মুলাডুলি হাটে এ বছর বিকিকিনি অর্ধেকেরও নীচে নেমে এসেছে। আবাদ কম হওয়ায় হাটে শিমের আমদানি কমে গেছে উল্লেখ করে আড়তদার রেজাউল করিম সোহেল জানান, এখন শিম বিকিকিনির ভরা মৌসুম চলছে। প্রতিবছর এসময় গড়ে প্রতিদিন মুলাডুলি হাটে ৭০ থেকে ৮০ ট্রাক শিম কেনাবেচা হতো। এর বিপরীতে এখন প্রতিদিন গড়ে কেনাবেচা হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩০ ট্রাকের মতো।

বাড়ছে কীটনাশকের ব্যবহার

শিম বিপ্লবের পাশাপাশি আবাদের সময় বাগানে কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ছে। মুলাডুলী ঘুরে দেখা গেছে, শিম আবাদ এলাকার মুলাডুলীতে সিনজেনটা, অটো, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার, ইথারটন, গ্লোবাল, এসিআই, সেতু, বায়ার, সেমকো, সি ট্রেড, স্কয়ার, ম্যাপ এগ্রো, ইষ্টওয়েষ্ট কেমিকেল, এমাগ্রীণ, এমিন্যান্স কেমিকেল, হেলিস, আইসিএস, লার্ক, এসএএম এগ্রো কেমিকেল, রাভেন, গ্লোবাল এগ্রোভেটসহ প্রায় শতাধিক কোম্পানী তাদের বিভিন্ন ধরণের সার ও কীটনাশক বিপনন করছে। এসব কোম্পানীর কেউ ডিলারের মাধ্যমে কেউবা বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগ করে  নগদে ও বাকিতে তাদের কোম্পাানীর কীটনাশক চাষীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। চাষী, আড়তদার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শুধু শিম মৌসুমে এসব কোম্পানী শিম সাগর এলাকায় শত কোটি টাকার ব্যবসা করে।

শুধু মুলাডুলী বাজারেই রয়েছে কীটনাশকের ৪০টিরও বেশী দোকান। পাশের রাজাপুর বাজারে রয়েছে আরো ১০ থেকে ১২ টি দোকান। রামেশ্বরপুর গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান, গোলাম মওলা জানান, জমিতে শিম রোপণের আগ থেকে শিম তোলা পর্যন্ত সব পর্যায়ে তারা জমি ও গাছে কীটনাশক স্প্রে করেন। এবার অতি বর্ষন হওয়ায় পচন রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী হওয়ায় চলতি বছর কীটনাশকের ব্যবহার অনেকগুণ বেশী বেড়ে গেছে।

মুলাডুলী এলাকায় কীটনাশকের অন্যতম ব্যবসায়ী খন্দকার ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী মনিরুল ইসলাম জানান, শিম মৌসুমে মুলাডুলি ও আশপাশের এলাকার কীটনাশক ব্যবসায়ীরা ব্যবসার পুঁজি ও আয়তন ভেদে মাসে গড়ে ব্যবসা করছেন ২০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত। এসময় বড় বড় কোনো কোনো কোম্পানী এককভাবেই ব্যবসা করছে মাসে এক কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, শিমসাগর এলাকায় প্রতিবছর ভয়াবহভাবে বাড়ছে কীটনাশকের ব্যবহার।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে ম্যাপ এগ্রো নামের কীটনাশক কোম্পানীর পাবনা অঞ্চলের বিক্রয় কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, শিম মৌসুমে ম্যাপ এগ্রো শিমসাগর এলাকায় প্রায় ৪০ ধরনের প্রোডাক্ট চাষীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৭ টি প্রোডাক্ট ছত্রাকনাশক এবং বাকিগুলো বিভিন্ন সার ও কীটনাশক। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে যতগুলো কীটনাশক কোম্পানী ব্যবসা করছে তার শতকরা ৮০ ভাগই মুলাডুলীতে ব্যবসা করছে। শিম মৌসুমে তারা প্রায় সকলেই বাম্পার ব্যবসা করে। স্থানীয় চাষীদের কীটনাশকের ব্যবহারে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে জানিয়ে কীটনাশক কোম্পানীর এই বিক্রয় কর্মকর্তা জানান, চাষীদের এই আগ্রহকে পুঁজি করে অনেক ভুঁইফোঁড় কোম্পানী তাদের নি¤œমানের পণ্য কৃষকদের কাছে বিক্রি করছে। এতে জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কাংখিত ফলন পেতে কৃষক প্রতারিত হচ্ছে।

কীটনাশকের কোম্পানীতে চাকরী করা বিক্রয় প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরাও জানেন কীটনাশকের ক্ষতিকর দিকটির কথা। নাম না প্রকাশের শর্তে মুলাডুলীতে একটি কীটনাশক কোম্পানীর বিক্রয় কর্মকর্তা জানান, কীটনাশক মানেই বিষ। এটা জমির ক্ষতি করে। সব জেনে বুঝে চাকরী বাঁচানোর জন্য আমরা এই বিষ বিক্রি করছি। তিনি আরো জানান, চলতি শিম মৌসুমে তার টার্গেট ছিলো ৪০ লাখ টাকা যার পুরোটাই অর্জন হয়েছে। ম্যাপ এগ্রোর আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক সাহাদুল ইসলাম ফিরোজ জানান, সকল কীটনাশকই বিষ। এই কীটনাশক জমিতে এবং গাছে দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানতে হয়। স্থানীয় চাষীরা সেই নিয়ম না মেনেই জমিতে অধিক পরিমাণে এবং বারে বারে কীটনাশক  প্রয়োগ করায় ক্ষতির পরিধি বাড়ছে।

স্থানীয় চাষীরা কীটনাশককে বিষ বলে। চাষীরা জানালেন, ৬ থেকে ৭ বছর আগেও শিমসাগর এলাকায় কীটনাশকের এতো বেশী ব্যবহার ছিলো না। চাষী সোবহান মন্ডল, আবু শামা জানান, পোকা দমনের জন্য তারা নীল-৫এসজি, ফ্রিজ-৫এসজি, ওয়ান্ডার-ডব্লিউজি, ইমাকস-৫এসজি, ডায়না-৫এসজি, গিল্ডার-৫এসজি সহ কয়েকটি কীটনাশক এবং ছত্রাক দমনের জন্য ইন্ডাফিল, পেনকোজেব, ডায়থেন-৪৫ সহ কয়েকধরণের কীটনাশক ব্যবহার করেন। আর আবহাওয়া মেঘলা হলে ঘন ঘন স্প্রে করেন চাষীরা। গাছ থেকে শিম পাড়ার কমপক্ষে ৭ দিন আগে কীটণাশক স্প্রে করার নিয়ম থাকলেও অনেক অসাধু ব্যবসায়ী ও কৃষক তা না মেনে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বার কখনো তার চেয়েও বেশী স্প্রে করেন।

বিশেষজ্ঞরা যা বললেন

সাম্প্রতিককালে মুলাডুলীসহ শিমসাগর এলাকায় কীটনাশকের ব্যবহারকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনেকেরই ধারনা, কীটনাশকের কুপ্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মানবদেহের জন্য হুমকি ডেকে আনতে পারে।

দোতালা কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবক এবং কপিরাইট হোল্ডার কৃষিবিদ জাফর সাদিক জানান, যে কোনো কীটনাশকই মানুষের শরীরের জন্য মারাতœক ক্ষতিকর। তিনি জানান, শিম আবাদে জমির উর্বরতা বাড়ার কথা। কিন্তু শিমচাষের সময় অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা দিনদিন কমছে। তিনি আরো জানান, বায়োসেফটি ডিভাইসে বলা আছে, কীটনাশক দেয়ার পর কমপক্ষে ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে শিম তোলা যাবে না। অথচ কৃষকরা অধিক মুনাফার আশায় সপ্তাহে একাধিকবার গাছে স্প্রে করছে কিংবা গাছ থেকে শিম সংগ্রহ করছে। যারা এই নিয়ম মানছে তাদের শিম অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত বলেও জানান এই কৃষিবিদ।

ঈশ্বরদী আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড.আলতাফ হোসেন  জানান, শিমসাগর এলাকার কৃষকরা জমিতে কীটনাশক দিতে দিতে এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাদের বেশীর ভাগের এটা ম্যানিয়ায় পরিণত হয়েছে। অনেক কৃষকের জমিতে কীটনাশকের প্রয়োজন না থাকলেও শুধু অন্য একজন জমিতে কীটনাশক দিচ্ছে এটা দেখেই আরেকজন কীটনাশক স্প্রে করছে। অপ্রয়োজনে অপরিকল্পিতভাবে এই কীটনাশক দেয়ায় ফাইটোটক্সিক ইফেক্টে গাছের জীবনকাল কমে যাচ্ছে। গাছ হলুদ ও ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। সেই হলদে গাছকে সবুজ করতে কৃষক আবারো জমিতে নতুন করে সার বা হরমোন দিচ্ছে। আর এভাবে একই গাছে সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করা হচ্ছে। এরই মাঝে শিম তুলে তা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

ড.আলতাফ আরো জানান, শিমসাগর এলাকায় কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করছে কীটনাশক কোম্পানীগুলো। অনেকের প্রয়োজন না থাকলেও কীটনাশক কোম্পানীর লোকেরা নানা প্রলোভনে কৃষককে কীটনাশক ব্যবহারে প্রলুব্ধ করছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের প্রভাব পড়ছে মানুষের শরীরে। ফলে ক্যানসার, আলসার, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, কিডনীর জটিলতা সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি আরো জানান, যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেনো সব কীটনাশকই মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। প্রত্যেকটি কীটনাশক দেয়ার নির্দিষ্ট সময় আছে। নির্দিষ্ট সময়ের বিরতির পর তা গাছ থেকে তুলতে হয়। এই ইন্টারভ্যালটা মানলে সমস্যা নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিক মুনাফার আশায় কৃষক সেটা না মানায় ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার সময় কৃষক হাতে গ্লাভসসহ অন্যান্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা নিজেরাও ঝুঁকিতে পড়ছে বলেও তিনি জানান।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক এ বি এম মোস্তাফিজার রহমান জানান, শিম মূলত শীতের ফসল। কিন্তু অধিক মুনাফার আশায় চাষীরা তা আগাম আবাদ করছে। আর এই আগাম আবাদটা হচ্ছে উষ্ণ মৌসুমে। তিনি জানান, কিন্তু উষ্ণ মৌসুমের ২৩ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে আবাদের করার ফলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার করতে বাধ্য হয় কৃষক। কারণ এসময় পোকামাকড়ের উৎপাত থাকে বেশী। আর অতিরিক্ত এই কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পড়ে মানব শরীরে। আগাম আবাদের ফলে চাষীরা যে সব কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করছে তার মধ্যে সিসটেমিক পয়জন এবং কনট্যাক্ট পয়জন দুটোই রয়েছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে সিসটেমিক পয়জন সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে যা মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভুতি ভূষন সরকার  জানান, যথেচ্ছ ব্যবহার না করে পরিমিত ব্যবহার করলে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব খুব একটা নেই। সঠিকমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তার বিভাগের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে দলীয় সভা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে।

মেহেরপুরে চাষিরাও খুশি

আগাম শিম চাষ করে মেহেরপুরের চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন। ভাল ফলন ও দাম পাওয়ায় চাষিদের মুখে হাসি ফুটেছে। ধান-পাট চাষের অব্যাহত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাদের এই শিম চাষ। বিগত বছরের চেয়ে এবার তারা শিমের বেশী দাম পাচ্ছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং আরো এক মাস ভাল দাম পেলে প্রত্যেক শিম চাষির ঘরে আনন্দের বন্যা বইবে এমন প্রত্যাশা এ জেলার শিম চাষিদের।

মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের কাঁঠালপোতা, সোনাপুর, পিরোজপুর, টুঙ্গি ও গহরপুরসহ কয়েকটি গ্রামের মাঠে প্রচুর পরিমাণ শিম চাষ হয়েছে। এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ শিম ফুলে ভরে গেছে। চাষি শিমেেত সেচ ও বীজ দিচ্ছে। করছে শিম গাছের পরিচর্যা। কেউ তুলছেন শিম। পিরোজপুর ইউনিয়নের কাঁঠালপোতা গ্রামের মাঠে প্রায় সাড়ে ৭০০ বিঘা ও টুঙ্গি গ্রামের মাঠে প্রায় ২৫০ বিঘা জমিতে শিম চাষ হয়েছে। এছাড়া সদর উপজেলার আমদহ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মাঠে ও মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মাঠে প্রচুর পরিমাণে শিম চাষ হয়েছে।

টুঙ্গি গ্রামের মাঠে কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, স্থানীয়ভাবে তৈরি উন্নত জাতের বিস্কুট শিম চাষ করেছেন এলাকার চাষিরা। জানা যায়, ওই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক সাড়ে ৪ বিঘা, রিহান ২ বিঘা, ইয়ামিন, মহাসিন, কাশেম, মধু ও আব্দুল হান্নান এক বিঘা করে জমিতে শিম চাষ করেছেন। তারা জানান, সাধারণত মাঝ আষাঢ়ে শিম চাষ করতে হয়। এবার এলাকার চাষিরা শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি শিম চাষ শুরু করেছেন। আগাম শিম উঠছে। মেহেরপুরের বাজারে পাইকারী ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা মন দরে এ শিম বিক্রি হচ্ছে।

পিরোজপুর গ্রামের চাষী আকাশ দেড় বিঘা জমিতে শিম চাষ করেছেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত তার ৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। শিমের আবাদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তার দেড় বিঘা জমির পিছনে ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। গেল সপ্তাহে তিনি প্রথম দিনে ২৫ কেজি শিম তুলেছেন। মেহেরপুর বাজারে ওই শিম ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। তিনি এখন প্রতি সপ্তাহে শিম তুলবেন। তিনি বলেন, মাঘ মাস পর্যন্ত ক্ষেত থেকে সীম তোলা যাবে। ভাল দাম পেলে বিঘা প্রতি ৬০ হাজার টাকার সীম বিক্রি করতে পারবেন। যদি আরো এক দেড় মাস প্রতি কেজি সীমের দাম ৪০ টাকা বা তার বেশী পান তবুও বিঘা প্রতি ৪০ হাজার টাকার শিম বিক্রি করতে পারবেন।

টুঙ্গি গ্রামের চাষী হযরত আলী জানান, তিনি পঁচিশ কাঠা জমিতে শিম চাষ করেছেন। তিনি জানান, গেল সপ্তাহে প্রথম দিনে ক্ষেত থেকে ২ মন শিম তুলে মেহেরপুরে পাইকারী ৩ হাজার টাকা মন দরে বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ওই জমিতে তার যে খরচ হয়েছে তা প্রথম দিনের বিক্রিত শিমের দামে ওঠে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে চাষ, বীজ-সেচ, সার-বিষ ও লেবার বাবদ প্রতি বিঘা শিমে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হবে। গত বছর তার মাত্র ১০ কাঠা জমিতে শিম চাষে খরচ বাদে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। এ বছরও তিনি মোটা টাকা লাভের আশাবাদী।

মেহেরপুর ছোট বাজারের সবজি ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন জানান, বাজারে খুচরা শিম বিক্রির জন্য আসছে না বললেই চলে। গ্রামের চাষীরা বিকেলে শিম নিয়ে আড়তে দিচ্ছে। রাতে ট্রাক ভর্তি হয়েছে রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলার যাচ্ছে ওই শিম ।

মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, এবছর শিম চাষ ভাল হয়েছে। আবহাওয়া বৈরি না হলে শিম চাষে চাষি খুব ভাল লাভবান হবেন। এ বছর সদর উপজেলায় ২০৭ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পিরোজপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মাঠে ১৬০ হেক্টর জমিতে শিম রয়েছে।

এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে, এবছর জেলার ৩ উপজেলার বিভিন্ন মাঠে ২৬৫ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২০৭ হেক্টর ও মুজিবনগর উপজেলায় ৫১ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। শিমের ফলন ভাল হওয়ায় ও কৃষক ভাল দাম পাওয়ায় জেলা কৃষি বিভাগও খুশি।

লেখকঃ- কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল

সূত্রঃ কৃষি বার্তা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে