gg

বিডি নীয়ালা নিউজ(২৯ই ফেব্রুয়ারী১৬)-কৃষি প্রতিবেদনঃ আমাদের দেশে শাক সব্জির উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। ১১.৬৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন বাৎসরিক চাহিদার অনুকূলে উৎপাদন মাএ ৩.৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন (ঞযব ঋরহধহপরধষ বীঢ়ৎবংং, ৭ ঔঁহব, ২০১৩)। তাছাড়া সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বৎসর প্রচুর পরিমাণে শাক-সব্জি নষ্ট হয়ে যায়। ঐড়ৎঃবী ঘবংিষবঃঃবৎ এর সংখ্যা ৯(২) অনুযায়ী সাধারণভাবে আমাদের দেশে উৎপাদিত উদ্যানতাত্বিক ফসলের এক তৃতীয়াংশের বেশী সংগ্রহ পরবর্তী স্তরে প্রধানতঃ সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ব বিভাগ কতৃক কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, আম, লিচু, কলা, কমলা, শসা, ফুলকপি, টমেটো, ঢেঁড়শ, বেগুন, লালশাক প্রভৃতি প্রধান ১৩ টি ফল ও সব্জির উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় আমাদের দেশে বৎসরে ৩,৪৪২ কোটি টাকার ফল ও সব্জি শস্য সংগ্রহ পরবর্তী স্তরে নষ্ট হয় (ঞযব উধরষু ঝঃধৎ, ৮ ঙপঃড়নবৎ, ২০১১)। তবে সব্জির জাত ও ধরণ ভেদে পচেঁ যাওয়ার পরিমাণে তারতম্য দেখা যায়। যেমনঃ ৩৭% টমেটো, ৩৫% পেঁপে, ৩৩% আম এবং ২৭% করলা শস্য সংগ্রহ স্তর থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌছানোর মধ্যবর্তী স্তরে নষ্ট হয়ে যায় (ইঅজও, ২০০৬)। সুতরাং এ কথা নির্দির্¦ধায় বলা যায় যে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে শস্য সংগ্রহ পরবর্তী স্তরে ফসলের অপচয় উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস করা সম্ভব।
আজকে আমরা টমেটো সংরক্ষণের একটি নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে জানব। বলে নেয়া ভাল যে পদ্ধতিটি কোন গবেষণাগারে সৃষ্টি হয়নি বরং একজন উন্নয়ন কর্মী এবং একজন উৎসাহী কৃষকের যৌথ প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত। মোঃ হারুন অর রশিদ একজন উন্নয়ন কর্মী যিনি কৃষি বিষয় নিয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করার পর বিএসসি শেষ করে ১৯৯২ সালে যোগ দেন ব্রাকে। পরবর্তীতে কৃষি বিষয়ে জানার অদম্য আগ্রহ নিয়ে যোগ দেন ঈঅজঊ বাংলাদেশের খওঋঊ প্রকল্পে। কৃষি, মৎস্য এবং পশুপালন বিষয়ে চার মাসের ট্রেনিং নেয়ার পর যোগ দেন একই সংস্থার চধৎঃরপরঢ়ধঃড়ৎু ধপঃরড়হ ৎবংবধৎপয ঃবধস এ । এ টিমের মূল কাজ ছিল কৃষকের ক্ষেতে ঞৎরধষ ধহফ বৎৎড়ৎ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক সমস্যার স্থানভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করা। উল্লেখ্য, এই প্রজেক্টের একজন ভারতীয় উপদেষ্টা ড. নন্দী শাহাজী যিনি মনে করতেন কৃষকেরাই প্রকৃত গবেষক অর্থাৎ ঋধৎসবৎং ধৎব ঝপরবহঃরংঃ মতবাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হন মো: হারুন অর রশিদ। ১৯৯৯ সালে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় কাজ করার সময় তিনি দেখলেন এই এলাকায় টমেটোর বাম্পার ফলন হয় কিন্তু মূল্য কম হ্ওয়ায় অনেক কৃষক টমেটো ক্ষেতেই ফেলে রাখেন। এপর্যায় মোঃ হারুন অর রশিদ লক্ষ্য করেন যে বোঁটাসহ ক্ষেতে ফেলে রাখা টমেটোগুলো দেরিতে নষ্ট হচ্ছে। উৎসাহী হয়ে তিনি ছড়াসহ বেশ কয়েকটি পাকা এবং আধাপাকা টমেটো বাড়িতে

এনে ঝুলিয়ে রাখেন। আশ্চর্য হয়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে টমেটোগুলো স্বাদ গন্ধ ঠিক রেখে প্রায় দুই মাস অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। এর পর কেটে গেছে অনেকগুলো বৎসর। সময়ের আবর্তনে মো: হারুন অর রশিদ ক্লাস্টার কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ঝড়পরধষ অংংড়পরধঃরড়হ ভড়ৎ জঁৎধষ অফাধহপবসবহঃ (ঝঅজঅ) নামের ময়মনসিংহের একটি স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায়। সৌহার্দ কর্মসূচী-২ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিচয় হয় ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার ধারা ইউনিয়নের কুতুরা গ্রামের ৩৭ বৎসর বয়সী এসএসসি পাস উৎসাহী কৃষক আজিজুল ইসলামের সঙ্গে। ১৫ শতাংশ জমিতে কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে কেবল সুষম সার এবং বোর্দো মিশ্রণ ব্যবহারের মাধ্যমে টমেটো চাষ করে বাম্পার ফলন পান কৃষক আজিজুল ইসলাম । তবে কেজি প্রতি মূল্য মাত্র ২ টাকা হওয়ায় হতাশ হয়ে পরেন এই উৎসাহী মানুষটি। এমতাবস্থায় মোঃ হারুন অর রশিদের পরামর্শে টমেটোগুলো বোটাসহ কেঁটে কয়েক ঘন্টা রোদে শুকিয়ে একটি আবদ্ধ ঘরে সুতা দ্বারা সারিবদ্ধভাবে ঝুলিয়ে সংরক্ষণ করেন কৃষক আজিজুল ইসলাম। পাড়া প্রতিবেশীর হাসি ঠাট্টার ভয়ে তিনি রাতে সোলার লাইট জ্বালিয়ে টমেটো বাঁধা ও ঝুলানোর কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। ৭ফুট চওড়া ৮ ফুট প্রশস্থ এবং ৯ ফুট উচ্চতার একটি ঘরে এভাবে তিনি ৮ মণ টমেটো কাঠের আড়াআড়ি মাচায় ঝুলিয়ে রাখেন। আজিজুলের মতে সঠিক পদ্ধতিতে ঝুলালে এই সাইজের একটি ঘরে ৩০ মণ টমেটো ঝুলিয়ে রাখা সম্ভব। টমেটোর থোকাগুলো ঝোলানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বেশী চাপাচাপি হয়ে না যায়। ঝুলানোর জন্য অবশ্যই পাকা বা আধাপাকা (৯০% পাকা) সুস্থ টমেটো নির্বাচন করতে হবে। মনে রাখবেন কোন টমেটো বোঁটা থেকে পৃথক হয়ে গেলে সেটাকে আর এ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। এভাবে টমেটো ঝোলানোর জন্য বাড়তি তেমন কিছু করার প্রয়োজন হয় না। তবে ইঁদুর ও পোকামাকড় থেকে টমেটো নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কৃষক আজিজুল জানান ইঁদুর দমনের জন্য তিনি জিংক ফসফেট পাউডার চিনির সাথে কাগজে পেঁচিয়ে টোপ তৈরী করে ঘরের চালে রেখে দিয়েছিলেন। তাছাড়া পোকামাকড় দমনের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা স্বরূপ তিনি ইমিটাফ নামের একটি ওষুধ আধা লিটার পানিতে মিশিয়ে ঘরের দেয়ালে ছিটিয়ে দিয়েছিলের। কৃষক আজিজুলের মতে ঘরটি ভালভাবে পরিস্কার-পরিছন্ন করতে পারলে কীটনাশক ছিটানোর প্রয়োজন নেই। টমেটোগুলো ৮৫ দিন সংরক্ষণ করার পর তিনি ২২ টাকা কেজি দরে টমেটোগুলো বিক্রি করেন। এভাবে টমেটো সংরক্ষণ করতে তিনি কেজি প্রতি সুতা, মাঁচা অন্যান্য খরচ বাবদ মাএ দুই টাকা বাড়তি ব্যয় করেছেন বলে জানান। কাজেই এ প্রক্রিয়ায় টমেটো সংরক্ষণ করে আজিজুল ইসলাম কেজি প্রতি বাড়তি ১৮ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করেছেন। অথাৎ মোট আট মন টমেটোতে বাড়তি লাভ করেছেন ৫৭৬০ টাকা। তবে মোঃ হারুন অর রশিদ জানান এ প্রক্রিয়ায় ৩-৪ মাস টমেটো সংরক্ষণ করা গেলেও বাড়তি মাএ ১৫ দিন সংরক্ষণ করতে পারলে কৃষকের পক্ষে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কৃষক আজিজুলের দ্ওেয়া তথ্যানুযায়ী তার চাষকৃত ১৫ শতাংশ জমিতে টমেটো উৎপাদিত হয়েছিল ২৪০ মণ যার মাত্র ৮ মণ তিনি সুতা দ্বারা বেঁধে সংরক্ষণ করেছিলেন। কাজেই পুরো টমেটো সংরক্ষণ করতে পারলে তার মোট মুনাফা দাঁড়াত ৪৩,২০০ টাকা।

ছবিঃ সুতায় ঝুলিয়ে ৩ মাস ধরে সংরক্ষন করা টমেটো হাতে মোঃ হারুন অর রশিদ পিছনে কৃষক আজিজুল ইসলাম (সংগ্রহে লেখক)

আমাদের দেশে প্রতি বৎসর প্রচুর পরিমাণে টমেটো ক্ষেতেই পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া টমেটো একটি অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং সহজপাচ্য ফল। কাজেই এ প্রক্রিয়ায় টমেটো সংরক্ষণ করে কৃষক যেমন হতে পারেন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান তেমনি আমরাও পেতে পারি বছরজুড়ে টমেটো উপভোগের নিশ্চয়তা।
(উল্লেখ্য যেহেতু আমাদের জানামতে টমেটো সংরক্ষনের এ প্রক্রিয়াটি নিয়ে তেমন কোন গবেষণা পরিচলিত হয়নি কাজেই এ বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট গবেষকদের অনুরোধ জানাচ্ছি এবং কৃষক আজিজুলের তথ্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য ঈঅজঊ ইধহমষধফবংয এর কর্মকর্তা কৃষিবিদ সেলিম উদ্দিন এবং কৃষিবিদ মাসুদ মন্ডলের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

লেখকঃ-

মোঃ মামুন-উর-রশিদ
সহকারী অধ্যাপক,
কৃষিসম্প্রসারণ ও গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে