সিরাজগঞ্জথেকে,মারুফ সরকারঃসিরাজগঞ্জের কাজিপুরের নাটুয়ারপাড়া হাটসহ যেকোনো হাটেরই একটা কমন বৈশিষ্ট্য হলো টাকার বিনিময়ে পণ্য বেচাকেনা। একজন বিক্রেতা আরেকজন হলেন ক্রেতা। তবে এই সাধারণ নিয়মের বাইরে এমন হাটও আছে যেখানে টাকার বিনিময়ে কোনো পণ্য বিক্রি হয় না। কারণ সে হাটে মানুষ নিজেরাই পণ্য। নির্ধারিত একটি সময়ের জন্য একজন আরেকজনের কাছে বিক্রি হয়ে যান। আর যারা বিক্রি হন তারা সবাই বাদাম, ধান, তিল ও পাট কাটার শ্রমিক। নাটুয়ারপাড়া, আলমপুর, কুমারিয়াবাড়ী, পানাগাড়ী, রতনকান্দি ও সোনামুখী এলাকায় এই মানুষ বিক্রির হাট এখন জমজমাট। এর মধ্যে নাটুয়ারপাড়া হচ্ছে অন্যতম। প্রতি হাটের দিন এই হাট বেশ জমে ওঠে।

এই সময় কাজিপুরের মাঠে মাঠে বাদাম, পাট ও তিলের সমারোহ থাকে। শ্রমিকের দামও থাকে বেশ চড়া। রবিবার নাটুয়ারপাড়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, কারো হাতে বাঁশের তৈরি বাইং, কারো হাতে ব্যাগ। ব্যাগে হালকা কাপড়-চোপর আর কাঁচি। কেউ বসে আছে, কেই দাঁড়িয়ে। হাটের ভেতরে ঢুকতেই এক শ্রমিক হ্যান্ডশেইকের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘মামা কামলা লাগবো? কত দিবেন?’ বাড়ানো হাত ধরেই সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হয় তার সাথে। তার নাম আব্দুর রশিদ (৪৮)। বাড়ি বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার বিজরীল গ্রামে। তিনিসহ সাতজনের একটি দল ওইদিনই নাটুয়ারপাড়া আসেন।

অন্য ছয়জন ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছেন। তিনি আরো বেশি দামে বিক্রি হওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আসেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এখন কোনো কাজ নেই। বইসা থাইকা কি করব? তাই এখানে পাট কাটার জন্য আছি। কিছু টাকা জমিয়ে চলা যামু।’ রংপুর থেকে দুদু মিয়া (৪৬)। এ দলেও সদস্য নয়জন। দুদু বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এখন কোনা কাজ নাই। বইসা থাকার চেয়ে বেকার খাটা ভালো। ১০/১৫ দিন পাট কাইটে চইল্লা যামু।’ প্রতি বছরই তিনি এই এলাকায় পাট কাটতে আসনে বলে জানান। আক্ষেপ করে দুদু জানান, তার ৮ বিঘা জমি ছিল। ১৬ বছর আগে রাক্ষেষে নদী তা কেড়ে নিয়েছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে এখন অন্যের জায়গায় থাকেন।

এজন্য তাকে ভাড়া দিতে হয়। তার দলে রাশেদ নামে নবম শ্রেণীর একজন ছাত্রও আছে। রাশেদ বলেন, ‘এখন ইসকুল রেজার বন্ধ আছে। তাই আব্বার সাথে পাট কাইবার আইছি।’ বগুড়ার ধুটের বাঁশপাতা গ্রাম থেকে আসা একটি দলের প্রধান হলেন ফললুল হক (৪৫)। এ দলের সদস্য আটজন। ফললুল হক বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এখন কোনো কাজ নেই। মোকলেছুর রহমান, কুদ্দুস, সোহারাফ হোসেন, গোলাম হোসেন, সাইদুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, জহুরুল ইসলাম নন। উত্তরবঙ্গের রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আরো অনেকেই বিক্রি হওয়ার আশায় রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নাটুয়ারপাড়া হাটে দাঁড়িয়ে ও বসে থাকেন।

বিক্রি না হতে পারলে নাটুয়ারপাড়া স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ মাঠে রাতে থাকেন। জামালপুর থেকেও শ্রমিক আসেন এখানে।নাটুয়ারপাড়া হাটে কথা হয় চরছিন্না গ্রামের এক গৃহস্থের সাথে। তিনি বলেন, কামলার দাম গত বছরের চেয়ে এবার বেশি। তবু কিছু করার নেই। বাদাম, পাট ও তিল যমুনা নদীতে ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই বেশি দাম দিয়েই কামলা কিনতে হচ্ছে। কাজিপুর উপজেলার মাজনাবাড়ী গ্রামের কৃষক আমির হোসেন বলেন, আমি নাটুয়ারপাড়া থেকে ৩০০ টাকা দরে পাঁচজন কামলা (শ্রমিক) কিনছি। উত্তরবঙ্গের কামলাদের কাজের মান ভালো। কাজে কোন ফাঁকি দেয় না। তাদের তিনবেলা খাবার দিতে হয়। আর কাজ করে ভোর থেকে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত। বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, এখন একজন শ্রমিকের দাম ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। তাতে তিনবেলা খাবারসহ এক কামলার দাম পড়ে কমপক্ষে ৪০০ টাকা। আর এখন বাজারে এক মণ বাদামের দামও ১৮০০০ থেকে ২০০০ টাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে