Mir-Kasem-medium20160217064200

বিডি নীয়ালা নিউজ(২৫ই ফেব্রুয়ারী১৬)-আইন ও বিচার প্রতিবেদনঃ  মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মামলার শেষ দিনের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এ মামলা আপনারা কোনো রকম দায়সারাভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এটি দুঃখজনক। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরকে এনে আসামির সঙ্গে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।’

বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে শেষ দিনের মতো শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, মীর কাসেম আলী একজন মানিম্যান (টাকাওয়ালা)। মামলা থেকে বাঁচার জন্য অনেক জয়াগায় টাকার ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাসেডিয়ান অ্যাসোসিয়েটস লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে তিনি ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে চুক্তি করেছেন মর্মে লিখিত একটি নথি রয়েছে। এ সময় লিখিত নথিটি তিনি আদালতে উপস্থাপন করেন।

পরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা তাহলে এ বিষয়ে মানি লন্ডারিং আইনে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেননি কেন?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দুদকের কাছে এ সংক্রান্ত একটি আবেদন করা হয়েছে।

এ সময় মীর কাসেম আলীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মাই লর্ড, দুদকের কাছে এ বিষয়ে আবেদন জমা পড়লে দুদক তদন্ত করে দেখে এটি ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য। এ কারণে দুদক আবেদনটি বাতিল করেছে।’

প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, অপর একটি মামলায় (দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর) বরিশাল গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ মামলায় কোনো ভালো তথ্য দিতে পারলেন না।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি নিজে গিয়ে পিরোজপুরে তথ্য সংগ্রহ করেছি। কিন্তু প্রসিকিউশন ও তদন্ত কর্মকর্তা কেন পারল না, বুঝলাম না। তবে মীর কাসেম আলী আল-বদর নেতা হিসেবে ঘটনায় জড়িত ছিলেন। এটা সত্য কথা। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয়। ‘

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর ডালিম হোটেলে যে হত্যাকাণ্ড হয় সে সময়তো আপনাদের দেওয়া পত্রিকার কাটিংয়ে মীর কাসেম আলী ঢাকায় ছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। তাহলে সে চট্টগ্রামে গেল কীভাবে?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তখন তো ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা চালু ছিল। হয়তো ট্রেনে গেছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দেশে তখন রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো ছিল না। নৌপথে মানুষ চলাচল করত। ১৯৭১ সালের ২৩ তারিখ ঢাকার সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন মর্মে পত্রিকায় সংবাদ রয়েছে। তাহলে মীর কাসেম আলী কি চট্টগ্রামে হেলিকপ্টারে গেছে?’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় যেতেও পারে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বা সাক্ষীও বলেননি মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে ছিলেন। এসব তো আপনারা তাদের দিয়েও বলাতে পারতেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আল-বদর বাহিনীর নেতা হিসেবে মীর কাসেম আলী যা কমান্ড করত তাই হতো।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কমান্ডের প্রয়োজন হতো না। ওই সময় যার হাতে একটি বন্দুক ছিল, সে ক্ষমতাবান হয়ে যেত। যে রাজাকার যত বেশি কিলিং মিশন করত, সে তত বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠত। তবে আপনারা প্রসিকউশন টিম এ মামলা একেবারে দায়সারাভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা দুঃখজনক। ট্রাইব্যুনালের অন্য কোনো মামলায় এত দুর্বল তথ্য ছিল না।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘মীর কাসেম আলী যে একজন আল-বদর বাহিনীর নেতা হিসেবে অপরাধ করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি আশা করি তার সবোচ্চ সাজা বহাল থাকবে।’

উল্লিখত বক্তব্য দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কথোপকথন শেষ করেন।

মীর কাসেমের আইনজীবীর ভাষ্য

এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান ২০ মিনিট কথা বলেন।

এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন মীর কাসেমকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘মাই লর্ড, ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত আমি মীর কাসেম আলী চট্টগ্রামে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এত বিশাল সময়ে আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও আনা হয়নি। ওই সময়ে আমি চট্টগ্রাম বিভাগের ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলাম। পরে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ঢাকাতে থাকি। কেননা তখন আমি ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হলাম। ৭ নভেম্বরের পর থেকে চট্টগ্রামে ছাত্রসংঘের দায়িত্বে ছিল আবু তাহের নামে অপর ব্যক্তি। আমি ডালিম হোটেলে যাব কীভাবে?’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মীর কাসেম আলীর ভাগ্য ভালো দারোগা (তদন্ত কর্মকতা) বলেনি সে জড়িত ছিল। আমরা কারো পক্ষে বলছি না। বিচারকরা অন্ধ। আমরা নথি দেখে রায় দেব।’

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সাক্ষী ও তদন্ত কর্মকর্তারা সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। সুতরাং মীর কাসেম আলীকে বেকসুর খালাস দেওয়া হোক।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একেবারে বলবেন না দণ্ড দেওয়া যাবে না। বরং এটা বলেন মৃত্যুদণ্ড যেন দেওয়া না হয়। কেননা ১৯৭১ সালে কমান্ড রেসপনসিবলিটি বলতে কোনো আইন ছিল না। বরং যার হাতে বন্দুক ছিল সে ক্ষমতাবান।’

প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের পর শুনানি শেষে ৮ মার্চ রায়ের দিন ধার্য করা হয়।

মামলার সারসংক্ষেপ

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় মীর কাসেম আলীর পক্ষে আপিল করেন জয়নুল আবেদীন তুহিন। মীর কাসেমের পক্ষে ১৮১টি গ্রাউন্ডে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে এ আপিল করা হয়েছে।

 

ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা মোট ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়। এগুলো হলো ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ। এর মধ্যে দুটিতে (১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ) মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চারটি অভিযোগে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

১১ নম্বর অভিযোগে রয়েছে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ছয়জনকে আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ। এ অভিযোগে বিচারকরা সর্বসম্মতিক্রমে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ১২ নম্বর অভিযোগে রয়েছে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ। এ অভিযোগে বিচারকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেওয়া হয়। ১১ ও ১২ নম্বর ছাড়া বাকি ১২টি অভিযোগই অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ মীর কাসেমের বিরুদ্ধে।দ

প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে তাঁকে ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাঁকে সাত বছর করে মোট ৪২ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এই আটটি অভিযোগে তাঁকে সর্বমোট ৭২ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে এসব অভিযোগ থেকে খালাস (অব্যাহতি) দেওয়া হয়।

সূত্রঃ এনটিভি

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে