ডেস্ক রিপোর্ট : বিশ্বের যেসব দেশে বাল্যবিয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশী ঘটে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।তাই বলা যেতে পারে, দেশটিতে বাল্যবিয়ের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু নিজের বিয়ে ভাঙতে হাত কেটে ফেলার কথা এর আগে শোনা যায়নি।তবে এমনই একটি ঘটনা ঘটিয়েছেন বিথী আক্তার। আর ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামে।ওই গ্রামেরই একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বিথী আক্তার, বয়স ১৫ বছর।পড়াশোনা করতে আগ্রহী বিথীর অমতেই তার পরিবার এক বাস ড্রাইভারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে।

অল্প বয়সে বিয়ে করা ঠিক নয়, এই বিষয়টি তিনি বাবা-মাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে অনেকটা নিরুপায় হয়েই বিথী সিদ্ধান্ত নেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ফোন করার।”বয়স কম, ক্লাস নাইনে পড়ি । জোর করে বিয়ে দিতে চাইছিল ড্রাইভারের সঙ্গে”- উপজেলার সবচেয়ে বড় কর্মকর্তাকে ফোন করার কারণ ব্যাখ্যা করে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বিথী আক্তার।কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু নাসারউদ্দিন জানান হঠাৎ করেই গত সপ্তাহে তার কাছে বিথী নামের ওই কিশোরীটি ফোন করে।

“মেয়েটা আস্তে আস্তে বলছিল আপনি কি বাল্যবিয়ে ঠেকাতে পারবেন? আমি তখন বললাম পারবোনা কেন। মেয়েটি জানায় যে তারই বিয়ে ভাঙতে হবে। পরদিন বৃহস্পতিবারেই বিয়ে”।বৃহস্পতিবার অর্থাৎ জুন মাসের ২৯ তারিখে বিথীর গ্রামে যান উপজেলার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদেরকে সহযোগিতা করতে হাজির হন এলাকার কিছু মানুষ।এরা সবাই বিথীদের বাড়িতে গিয়ে দেখেন যে সেখানে পারিবারিকভাবে বিয়ের সব প্রস্তুতি চলছে।

কিন্তু বিথীর বাবা বেল্লালকে যখন বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে বলা হয়, তখন তিনি এক নাটকীয় মুহুর্ত তৈরি করেন বলে জানান আবু নাসারউদ্দিন।বিয়ে নিয়ে নাটকীয়তা”আমরা যাওয়ার কিছু পর পুলিশও আসলো। তাদের অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করলাম। অনেক পরে আসলো মেয়ের বাবা বেল্লাল। মেয়েকে বয়সের আগেই বিয়ে দিচ্ছেন কেন, এটা জানতে চেয়ে মেয়েটিকে ডেকে আনতে বললে তিনি এমন এক মেয়েকে এনে বসালেন, যাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল বয়স একটু বেশি” – বলছিলেন মি: নাসারউদ্দিন।

বিথী ওই কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি ক্লাস নাইনে পড়েন। কিন্তু যে মেয়েকে তার বাবা কর্মকর্তাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি মেট্রিক পাশ করেছেন এমনটা জানার পর সন্দেহ হয় কর্মকর্তাদের।এরপর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায় নিজের মেয়ের পরিবর্তে অন্য আরেকজনকে বসিয়ে দিয়েছেন বিথীর বাবা।আবু নাসারউদ্দিন বলছিলেন “আমি যখন বললাম আপনি মেয়ের পরিবর্তে নিজের বোনকে বসিয়ে দিয়েছেন, এটা কি ঠিক হলো? এমন সময় ফিক করে হেসে দেন বেল্লাল। অনেক পরে বিথীকে সবার সামনে নিয়ে আসেন তার বাবা”।”এই মেয়েকে দেখলে আপনার অনেক খারাপ লাগবে যে এমন বাচ্চা মেয়েটাকে এক ড্রাইভারের সাথে বিয়ে দেয়ার চিন্তা করেছে তার পরিবার”- বলেন তিনি।মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে, বিয়ের বয়স হয়নি, ১৮ বছরের আগে মেয়েকে বিয়ে দেয়া ঠিক নয় – এসব কথা বলে অনেক বুঝানো হয় বিথীর পরিবারকে।

“মেয়ের বাবা বলেন যে বিয়ে উপলক্ষে অনেক খরচ হয়ে গেছে, গরীব মানুষ। তখন বলি যে পরে যখন মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হবে বিয়ের সব খরচ আমি দেখবো, তবু এই বিয়েটা বন্ধ করেন”-বলেন মি: নাসারউদ্দিন।তিনি জানান, বিথীর বাবার কাছ থেকে মুচলেকাও নেয়া হয়েছে যে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের দিবেন না।টেলিফোনে ছেলের বাড়িকে নিষেধ করে, পড়ালেখার সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন কর্মকর্তারা।তাহলে কেন বিথীকে নিজের হাত কাটতে হলো?

বিথীকে জোর করে তার পরিবার বিয়ে দেবে না, এই আশ্বাস পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ পুলিশের দল যখন বিথীদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর তার পরিবার আবারো তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে।প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বিথী কান্নাকাটি করার পরও তার মা জোর করে তার বিয়ে দিতে চাইছিলেন।এমনকি বিথীকে মারধোরও করে তার মা – প্রতিবেশী ও উপজেলার তথ্য কর্মকর্তা এমনটাই জানিয়েছেন।যদিও বিথী কথায়, “মা হালকা দুই-একটা থাপ্পর মারছে”।

তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিথীর ফোলা চোখের পাশে তিনি আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন।বিয়ে নিয়ে মা-মেয়ের বাকবিতন্ডার মধ্যে এক পর্যায়ে উঠানে থাকা বটি মেয়ের দিকে ছুঁড়ে মারে তার মা।প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে মি. নাসারউদ্দিন বলেন, ওই সময় বিথী বটিটি নিয়ে বলে যে “আমিই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি, বলে বাম হাতে কোপ মারে”।বিবিসির সাথে আলাপকালে একধরনের জড়তা নিয়েই বিথী বলছিল “মা বকাঝকা দিছে। কিছু করতে পারছিলাম না। তাই নিজের হাত নিজেই কাটছি। রাগের মাথায় কাজটা করছি”।বটি দিয়ে কোপ দেয়ার কারণে হাতের তিনটি রগ কেটেছে বিথীর। তবে হাতের ব্যান্ডেজ নিয়েই তিনি এখন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার বিথী নিজের হাত কাটলেও খবরটা তিনি পেয়েছেন রোববার, অর্থাৎ ২রা জুলাই।”বিথী স্কুলে গেছে কি-না তা জানতে শনিবার ওর স্কুলে ফোন দেই। হেডমাস্টার জানায় যে ঘরে আত্মীয়স্বজন আছে তাদের বিদায় দিলো, এজন্য সে আসেনি। এরপর রোববার ফোন দিয়ে যখন জানলাম যে আসেনি, তখন সন্দেহ জাগে মেয়েকে বিয়ে দিল কি-না”।এরপর আবার বিথীদের বাড়ি গিয়ে ও তথ্য কর্মকর্তার সাহায্যে পুরো ঘটনা জানতে পারেন তিনি।

এবারে নিজের হাত কেটে বাল্যবিয়ে রুখলো বিথী। কিন্তু আবারো যদি পরিবার তাকে চাপ দেয় তাহলে সে কী করবে? “আর এমন করতে পারবে না বাবা-মা। বিয়ে দিতে চাইলে স্যারের কাছে শুনেই সেটা করবো”-বলেন বিথী।ভবিষ্যতে ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছার কথাও জানালেন বিথী আক্তার।

বি/এস/এস/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে