বিডি নীয়ালা নিউজ(২২ই ফেব্রুয়ারী১৬)-কৃষি প্রতিবেদনঃ মাছ চাষকে লাভজনক করতে অর্থাৎ বেশি করে উৎপাদন পেতে হলে উন্নতমানের খাদ্য প্রয়োগ যেমন অপরিহার্য তেমনি এটি একক বৃহত্তম খরচের বিষয়ও বটে। কারণ মাছ চাষে অবস্থাভেদে উৎপাদন খরচের শতকরা ৬০-৮০% খরচ হয় খাদ্য ব্যবহারে। মৎস্য খাদ্যের কার্যকারিতা শুধুমাত্র গুণগতমানের ওপর নির্ভর করে না, খাদ্য প্রয়োগ কৌশলের ওপরও তা অনেকাংশে নির্ভরশীল। সঠিক পদ্ধতিতে খাদ্য প্রয়োগ করা না হলে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ মৎস্য খাদ্যের কার্যকারিতা পাওয়া যায় না। প্রত্যেক প্রাণির এমনকি মাছের প্রতিদিন খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক একরকম হয় না। এই তত্বের ওপর ভিত্তি করেই গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে যে, মাছ চাষে প্রতিদিন চাহিদা মাফিক পুষ্টি সমৃদ্ধ (উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ) খাদ্য প্রয়োগ অপচয়মাত্র কারণ তা মাছের দেহে প্রতিদিন সমানভাবে পরিপাক হয় না। সুতারাং একদিন অন্তর অন্তর যথাক্রমে উচ্চ ও নিম্ন মাত্রায় আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগ কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে খাদ্য ও উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো সম্ভব। এতে মাছের উৎপাদন, প্রতিদিন উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্য (চাহিদা মাফিক আমিষ) প্রয়োগের চেয়ে কম হয় না বরং বেশীই হয়ে থাকে।
খাদ্য প্রস্তুত ও প্রয়োগ কৌশল
দেশে বহুল সম্প্রসারিত পাঙ্গাস চাষে এক দিন অন্তর উচ্চ ও নিম্ন মাত্রায় আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগের দুইটি সস্পুরক খাদ্য তৈরির মডেল সূত্র নিম্নে দেয়া হলো ঃ
সারণি: পাঙ্গাসের উচ্চ ও নিম্ন মাত্রায় আমিষ সমৃদ্ধ স¤পুরক খাদ্যের মডেল সূত্র
খাদ্য উপাদানের নাম খাদ্য- ১
(উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য, ২৮%) খাদ্য- ২
(নিš§ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য, ১৫%)
ব্যবহার মাত্রা
(%) সরবরাহকৃত
আমিষ (%) ব্যবহার মাত্রা
(%) সরবরাহকৃত
আমিষ (%)
ফিশ মিল/ প্রোটিন কনসেন্ট্রেড ১০.০০ ৬.০০ – –
মিট ও বোন মিল ২০.০০ ১০.০০ ১০.০০ ৫.০০
সরিষার/তিলের খৈল ২৫.০০ ৭.৬০ ৫.০০ ১.৫০
চালের কূঁড়া (অটো) ২০.০০ ২.৪০ ৪০.০০ ৪.৮০
ভূট্টা (মিহি) ২০.০০ ২.০০ ৪০.০০ ৪.০০
আটা (গমের) ৫.০০ – ৫.০০ –
সূত্রানুযায়ী উল্লেখিত খাদ্য উপাদানসমূহ নির্দিষ্ট পরিমাণে মেপে নিয়মানুযায়ী পিলেট মেশিনে শুস্ক পিলেট খাদ্য তৈরি করা যায় । চাষকৃত মাছের মুখের আকার অনুযায়ী নির্দিষ্ট আকারের ডাই ব্যবহার করে পিলেট মেশিনে প্রয়োজনীয় আকারের পিলেট খাদ্য তৈরী করা যেতে পারে। পুকুরে মজুদকৃত পাংগাসের মোট দেহ ওজনের (মাছের দৈহিক বর্ধনের ওপর) ৩-৮% হারে একদিন অন্তর অন্তর যথাক্রমে খাদ্য- ১ (উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য, ২৮%) এবং খাদ্য- ২ (নিম্ন আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য, ১৫%) দৈনিক দুইবার সকাল ও বিকাল বেলা পুকুরের চার পাড়ে ৪-৬ টি নিদিষ্ট জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে।
পাঙ্গাসের উৎপাদন এবং আয় ও ব্যয়
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অন-ষ্টেশন এবং মাঠ পর্যায়ে চাষীদের পুকুরে পাঙ্গাস চাষে দেশীয় খাদ্য উপাদান সহযোগে তৈরী দুটি সস্পুরক খাদ্য, একটি উচ্চ আমিষ (পাংগাসের চাহিদা মাফিক ২৮% আমিষ) সমৃদ্ধ অন্যটি নিম্ন আমিষ (১৫% আমিষ) সমৃদ্ধ খাদ্য যথাক্রমে একদিন অন্তর অন্তর প্রয়োগ করে সাত মাস চাষকালে পাঙ্গাসের গড় ওজন ৯৪৫ গ্রাম এবং হেক্টর প্রতি উৎপাদন ৩২.৬০ মেঃ টন (একর প্রতি ১৩.০৪ মেঃ টন) পাওয়া গেছে । আয়-ব্যয়ের হিসেবে মোট খাদ্যের শতকরা শতকরা ২৪% অপচয় রোধ এবং নেট মুনাফা ১.৪৮ গুন বেশী পাওয়া সম্ভব । কারণ উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্যের কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ নিম্ন আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্যের চেয়ে ৭-৮ টাকা বেশী হয় । ফলে এই পদ্ধতিতে খাদ্য প্রয়োগে নেট মুনাফা উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগের চেয়ে ১.৪৮ গুণ বেশী পাওয়া যায়। মাছের উৎপাদনও উচ্চ আমিষ সম্মৃদ্ধ খাদ্যের তুলনায় বেশি হয়।
এই প্রকার চাষ পদ্ধতিতে পুকুরে উৎপাদিত প্ল্যাংকটন নিয়ন্ত্রণের জন্য পাংগাসের সাথে শতাংশ প্রতি ১৫-২০টি সিলভার কার্প বা কাতলা মজুদ করা যেতে পারে। লাভজনক মাছ চাষে একদিন অন্তর অন্তর যথাক্রমে উচ্চ ও নিম্ন মাত্রায় আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগে তেলাপিয়া চাষেও খাদ্য বা উৎপাদনে খরচ বহুলাংশে কমানো সম্ভব। খাদ্যে প্রয়োগে এই পদ্ধতির সুবিধাসমুহঃ
* খাদ্যের অপচয় হয় না ও পুকুরে পানির গুণাগুণ ভাল থাকে এবং মাছ সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
* মাছের উৎপাদন বাড়ানোর সাথে সাথে উৎপাদন বা খাদ্য খরচ বহুলাংশে (শতকরা ২৪%) কমানো এবং প্রকৃত মুনাফা বেশী পাওয়া যায়।
* সহজেট খাপ খাওয়ানো পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতি
আহরণ পূর্ববর্তী খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের স্বাদ ও গুণগত মান বজায় রাখা
পাঙ্গাস আহরণের সময়ের ৩০ দিন পূর্বে নিম্নক্তো খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের স্বাদ ও গুণগত মান বজায় রাখা সম্ভব।
* মাছ আহরণের ১৫-৩০ দিন পূর্বে বাণিজ্যিক গ্র্রোয়ার মৎস্য খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ করে কম প্রাণীজ আমিষ, তৈল ও কম ভিটামিনযুক্ত ফিনিশার খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
* খাদ্য প্রয়োগ হার পূর্বের তুলনায় অর্ধেক/এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিতে হবে।
* মাছ আহরণের ২৪-৪৮ ঘন্টা পূর্বে খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
* পানির গুণাগুণ ঠিক রাখতে হবে। অধিক শ্যাওলা থাকতে পারবে না। শ্যাওলার আধিক্য দেখা দিলে তা দমন করতে হবে। প্রয়োজনে পানি পরিবর্তন করতে হবে।
আহরণ পরবর্তী সময়ে পরিচর্যার মাধ্যমে মাছের স্বাদ ও মান বজায় রাখা
পাঙ্গাস মাছ আহরণের পর বারবার মাছকে নলকুপের পরিস্কার পানি দিয়ে ভালভাবে ধৌত করতে হবে। পাইপ দিয়ে পানি ফ্লাস করে আরও ভালভাবে ধৌত করা যায়। পরিস্কার পানি দিয়ে বারবার ধৌত করলে মাছের গায়ের ময়লা ও শরীরের শ্লেষা চলে যাওয়ায় মাছের শরীরের অবাঞ্চিত গন্ধ দূরীভূত হয়, মাছের দেহের রং উজ্জাল হয় এবং মাছ বেশিক্ষণ ভাল থাকে। মাছকে তাজা অবস্থায় তাড়াতাড়ি বাজারজাত করতে হবে। এসব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আহরণকৃত মাছের স্বাদ ও মান ভাল থাকবে, চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং বাজারমূল্যও বেশি পাওয়া সম্ভব হবে।
উত্তম খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বিবেচ্য বিষয়সমুহ
* পুষ্টিমান বজায় রাখার স্বার্থে মাছের খাদ্যে স্বল্প পরিমাণে হলেও ফিশ মিল বা অন্যান্য প্রাণিজ আমিষ এবং ভিটামিন ও মিনারেল প্রিমিক্স ব্যবহার করতে হবে ।
* বাণিজ্যিকভিত্তিতে মাছ চাষের জন্য শুকনা পিলেট জাতীয় খাদ্যই সবচেয়ে উপযোগী। এটি পানিতে অধিকতর স্থিতিশীল, অপচয় কম হয়, প্রয়োগ করা সহজ এবং কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণের প্রয়োজন হয় না ।
* প্রতিদিন একই সময়ে একই জয়াগায় খাদ্য প্রয়োগে খাদ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয় ।
* পুকুরের পানির তাপমাত্রা এবং প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে খাদ্য প্রয়োগের হারও বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে। শীতকালে খাদ্য প্রয়োগের হার স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক বা তিন ভাগের এক ভাগ কমিয়ে আনতে হবে। প্রচন্ড শীতের সময় তাপমাত্রা বেশি কমে যায় বলে খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
* গ্র্রীস্মকালে পুকুরে পানি কমে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এবং পুকুরে শ্যাওলার স্তর পড়লে খাবার প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে বা বন্ধ রাখতে হবে।
* মাঝে মাঝে খাদ্য প্রয়োগস্থল পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রয়োগের যথেষ্ট সময় পরে খাবার থেকে গেলে বুঝতে হবে খাদ্যের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট না থাকলে আস্তে আস্তে প্রয়োগমাত্রা বাড়াতে হবে।
মো. জুলফিকার আলী
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট
সূত্রঃ কৃষিবার্তা