ডেস্ক রিপোর্ট : চলতি সপ্তাহের প্রথম তিন দিন রাজধানী শহরে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছিল যানজট। গতকাল বুধবার এর সঙ্গে যোগ হয় জটিল এক জলাবদ্ধতা। এই জলাবদ্ধতা আর যানজট বিপন্ন করেছিল রাজধানীর স্বাভাবিক জনজীবন। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে সরকারের বাস্তবসম্মত কোনো কর্মসূচি নেই।

মহানগরী ঢাকার এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে গতকাল জলাবদ্ধতা ও যানজট হয়নি। বাসাবো, মুগদাপাড়ার মতো অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা তো বটেই, আজিমপুর, নিউমার্কেট থেকে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা, মতিঝিল, ডেমরা এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় পর্যন্ত জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। গাড়ি ছাড়া যেসব কর্মচারী ও দর্শনার্থী সচিবালয়ে গেছেন, তাঁদের হাঁটুপানি ভেঙে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক ছিল যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের এই পানি সরাতে পাম্প ব্যবহার করতে হয়।

অঝর বৃষ্টিতে ভেসে গেছে নগরী। শান্তিনগর সড়কে থইথই পানি। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। গতকাল দুপুরের চিত্রএই পরিস্থিতিতে ডুবন্ত ঢাকাকে বাঁচাবে কে সেই প্রশ্নও উঠেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ও আপাত কোনো স্বস্তির কথা জানাতে পারেনি। অবশ্য পরিত্রাণের উপায় এবং সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এমন (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’ গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। গত আট বছরে ঢাকার পানিনিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর কিছু করেনি। সরকারও এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো কর্মসূচি নেয়নি। এখন পরিস্থিতি যখন সঙিন হয়ে উঠেছে, তখন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন এক বছরের মধ্যে সমস্যার সমাধান করবেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের কার্যত কোনো কর্মসূচি নেই। সরকার জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঝেমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। তারও সব বাস্তবায়িত হয় না। কিন্তু ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন করতে হলে পানিনিষ্কাশনের যে দীর্ঘমেয়াদি নিবিড় কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য, তা সরকারের নেই।

এ বিষয়ে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কর্মসূচি আর সিদ্ধান্ত এক নয়। পানিনিষ্কাশনের জন্য ঢাকা ওয়াসা নগরীর হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার করবে—এটি একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু খালগুলো কীভাবে উদ্ধার করবে, কত দিনের মধ্যে করবে, সরকারের কোন কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে কর্মসূচি। সরকারের এ রকম কোনো কর্মসূচি নেই।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর। গতকাল সকাল থেকেই কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমর ছোঁয়। এবড়োখেবড়ো ফুটপাত তলিয়ে গেছে পানিতে। ঝুঁকি নিয়ে হাঁটছে মানুষস্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের উদ্যোগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এবং পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। মেয়রের বিশেষ আমন্ত্রণে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীও সেই সভায় অংশ নেন। সেখানে আলাপ-আলোচনায় ঢাকার পানিনিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য একটি ‘কার্যকর, সময়নির্ভর ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা’ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে। সভায় এ রকম একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী কাজ শুরুরও সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকার খাল পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সেই মহাপরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। তা ছাড়া এই কাজের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন এবং আরও কোনো কোনো সংস্থাকেও যুক্ত করা দরকার। সেসব প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করতে সময় লাগবে।

ওই সভায় মেয়রের আমন্ত্রিত হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সেই সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করা গেলে আগামী বছর নাগাদ ঢাকার পানিনিষ্কাশনের সমস্যা কমার প্রবণতা শুরু হতে পারে। কিন্তু এই কাজ শুরু করার জন্য আইনের কোনো কোনো বিধিবিধান পরিবর্তন করতে হবে। সেটা সময়সাপেক্ষ। কাজেই কবে আসল কাজ শুরু করা যাবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আগামী বছর থেকে জলাবদ্ধতা হবে না বলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইকবাল হাবিব বলেন, কাজের কাজ না করে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারে যে কোনো ফল হয় না, তার প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন প্রয়োজনীয় কার্যক্রম না চালানোয় নগরীর সমস্যা অনেক বেড়েছে। আগে ভারী বৃষ্টি না হলে তেমন জলাবদ্ধতা হতো না। এখন গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিতেও নগরজুড়ে মারাত্মক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের ডাকা ওই সভায় একটি মত এসেছিল যে নগরীর পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব ওয়াসার। সেই কাজ যদি সিটি করপোরেশনকে করতে হয়, তাহলে ওয়াসাকে সিটি করপোরেশনের অধীনে দিতে হবে। অথবা নিদেনপক্ষে ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কথা হয়েছিল ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগকে সিটি করপোরেশনের আওতায় দেওয়া হবে।

ডুবে গেছে মিরপুরের কাজীপাড়ার সড়ক। পানিতে ঢাকা গর্তে পড়ে উল্টে গেছে রিকশাটি। যাত্রী আর রিকশাচালক দুজনেই অল্পতে রক্ষা পেলেনএখন সিটি করপোরেশন ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগকে নিতে চাইছে না বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সিটি করপোরেশন বলছে, একটি বিকলাঙ্গ শিশুকে (ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগকে অসুস্থ ও অকার্যকর বিবেচনা করে এই উদাহরণ দেওয়া) তাদের হাতে না দিয়ে, একটু সুস্থ করে বা সারিয়ে তুলে যেন দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তাই এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে নগরীজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি নেই নগরবাসীর। প্রায় সর্বত্র কাটা-খোঁড়া, এবড়োখেবড়ো, ভাঙা রাস্তা। গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতে সেসব রাস্তা ডুবে ছিল কোথাও হাঁটুপানিতে, কোথাও ছিল কোমরসমান। গতি ছিল না যানবাহনে। নগরীর সর্বত্র নেমে এসেছিল ভয়াবহ স্থবিরতা।

সকালে বাইরে বের হয়েই যারপরনাই সমস্যায় পড়েন অফিসযাত্রী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও পোশাক কারখানার কর্মীরা। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে থাকেন আলিমুল হক। কাজ করেন গুলশান ২ নম্বরের একটি বেসরকারি অফিসে। তিনি বলেন, গতকাল বাসা থেকে অফিসে যেতে আড়াই ঘণ্টা লেগেছে।

মিরপুর ১০ নম্বর থেকে শেওড়াপাড়ায় সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ই দেখছিলেন না তাহমিনা খাতুন। শেষে সন্তানের জুতা খুলে দুজনে হেঁটে রওনা দেন। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘কী আর করব। বাসা থেকে বের যখন হয়েছি, স্কুলেই যাই। ঢাকা শহরে এর চেয়ে ভালো থাকার কোনো সম্ভাবনা দেখি না।’

নগরীর প্রায় সব শিক্ষার্থীকেই গতকাল একই অবস্থায় পড়তে হয়েছে। একপর্যায়ে সমগ্র মিরপুর এলাকাই হয়ে পড়েছিল জলমগ্ন। ফলে অনেকে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই উপস্থিতি ছিল কম।

জলাবদ্ধতা সম্পর্কে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘নগরবাসী সবার মতো আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু মেয়রের হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই যে রাতারাতি সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে। আমরা চেষ্টা করছি। আল্লাহ চাহে তো আগামী বছর জলাবদ্ধতা কমবে।’

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন গতকালও নগরীর পানিনিষ্কাশনে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, এই জলাবদ্ধতার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসাকেই নিতে হবে। সিটি করপোরেশনকে যদি এই দায়িত্ব নিতে হয়, তাহলে ওয়াসাকে সিটি করপোরেশনের অধিভুক্ত করতে হবে।

অবশ্য ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকার চারপাশের সব নদীর পানি এখন বিপৎসীমার অনেক ওপরে। তাই নগরীর পানিনিষ্কাশনের সব স্লুইসগেট বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ জন্য পানি নামতে দেরি হয়েছে।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে গতকালও কোমরপানি জমেছিল। নিউমার্কেট ছিল পানিতে টইটম্বুর। আজিমপুর থেকে পলাশী, তারও দক্ষিণে পুরান ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। মানুষের ঘর থেকে বের হওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছিল। মতিঝিলে রাস্তা এবং ফুটপাত ছাপিয়ে অনেক ভবনের নিচতলা পর্যন্ত পানি ঢুকেছিল।

সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব অফিসেই সময়মতো সব কর্মকর্তা-কর্মচারী হাজির হতে পারেননি। অনেকে ভেজা জামাকাপড়ে অফিসে হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে থাকতে দেখা গেছে। কোনো কোনো রাস্তায় রিকশার আসন পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। সব মিলে সাধারণ মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি।

 প্র/ম/আ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে