ডেস্ক রিপোর্ট : চাল নিয়ে চালবাজি চলছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে একদিকে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে আমদানি নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে সমস্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতির উত্তরণে দ্রুত চাল আমদানি করা জরুরি। পাশাপাশি চাল আমদানি স্বাভাবিককরণে সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রয়োজনে ভ্যাট, ট্যাক্সও ছাড় দেওয়া যেতে পারে। এদিকে হঠাৎ করেই চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সারা দেশে ‘কড়া নজরদারি’ শুরু করেছে। তবে এখন পর্যন্ত মজুদদার চক্রকে চিহ্নিত করা যায়নি, অতিরিক্ত ধান-চাল মজুদ রাখার ঘটনাও উদ্ঘাটিত হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে রাজশাহীর পাইকার বাজার থেকে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই মোটা চাল উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে এক-দেড় মাসেই মোটা চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মিল থেকে পাইকারি বাজার পর্যন্ত দাম ঠিক থাকলেও অন্তত ১০ টাকা বেড়ে যাচ্ছে খুচরা বাজারে গিয়ে। বিক্রেতারা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ধানের জমি কমে গিয়ে উৎপাদন কমেছে চালের। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ না থাকায় বাজারে সংকটাপন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রটি জানিয়েছে, সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেট চাল নিয়ে চালবাজি চালানোর পাঁয়তারায় লিপ্ত। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে মজুদদারির গেঁড়াকলে চালের বাজার অস্থির করে তুলেছেন। মোটা চাল ক্রমেই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, চিকন চালের দামও যেন আকাশ ছুঁতে চলেছে। চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। রবিবার ও গতকাল রাজধানীর রামপুরা ও মেরাদিয়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের প্রধান খাদ্য মোটা চাল স্বর্ণা প্রতি কেজি ৫০, পাইজাম ৫০-৫২, চায়না ইরি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পারিজা ৫০, বিআর২৮ ৫০, মিনিকেট (একটু ভালো মানের) ৫৮-৬২, মিনিকেট (সাধারণ) ৫৪-৫৫, নাজিরশাইল ৫৪, বাসমতী ৬৫-৭০, কাটারিভোগ ৭৮, হাসকিনাজির ৫৪ এবং পোলাও চাল (খোলা) ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জসহ দেশের ছয় জেলায় বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে হাওরের ধান নষ্ট হয়ে যাওয়া ইস্যু পুঁজি করে মজুদদার সিন্ডিকেট ধীরলয়ে বাড়াতে থাকে চালের দাম। এরপর আর স্থিতিশীল হয়নি চালের বাজার। এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো মোটা চাল নেই। একটু ভালো মানের চিকন চাল কিনতে গেলেই কেজিপ্রতি গুনতে হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতে, গরিব মানুষের চালের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। দিন দিন এসব মানুষ নিজের পরিবার চালাতে হাঁপিয়ে উঠছে। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া দরকার। যারা বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায়, তাদের ব্যাপারে সরকার চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে। তারা হিমশিম খাচ্ছেন সংসার চালাতে। বিপাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও। এদিকে চালের এই নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারদের। পাইকারি বিক্রেতাদের অভিযোগ মজুদদার-মিল মালিকদের প্রতি। এর সুফল পাননি ধান উৎপাদনকারী কৃষক। কারণ কৃষকপর্যায় থেকে ন্যায্য মূল্যের চেয়ে কম দামে ধান কিনে মজুদ করা হয়েছে। এখন মজুদ ধানের দাম বাড়িয়ে চালের বাজার থেকে অতিমুনাফা করছেন মিল মালিক ও আড়দদাররা। অতিমুনাফালোভীদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় দালাল ও ফড়িয়ারাও। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ভিয়েতনাম থেকে জরুরি ভিত্তিতে ৬ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ চাল এলেই বাজার স্বাভাবিক হবে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় এ বছর আগাম বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। আরও ১৯টি জেলায় ধান খেতে ছত্রাকের আক্রমণে (ব্লাস্ট রোগ) উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দুই কারণে এ বছর ১০ লাখ টনের বেশি বোরো ধান নষ্ট হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। হাওরের আগাম বন্যার ভয়াল পরিস্থিতি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর পরও দেশে খাদ্যশস্য ঘাটতির সংকটাপন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে দাবি করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, এবারের মৌসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এ থেকে ১ কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় ৯ লাখ টন ধান উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। রমজানের শুরুতেই সচিবালয়ে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রতিনিধি নিয়ে হৃদ্যতাপূর্ণ বৈঠক করেন। বৈঠকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি চাহিদার তুলনায় বেশি আছে দাবি করে ব্যবসায়ীরা আশ্বাস দেন, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হবে না। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ এ আশ্বাসের মধ্য দিয়ে সরকারকে বিব্রত করাসহ আকস্মিক বিপাকে ফেলার কোনো কৌশল অবলম্বন করেছিল কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে চালকল মালিকদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চাল নিয়ে কারসাজি করছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে কিনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তাও।

খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তালিকাভুক্ত চালকল মালিকরা সরকারের সঙ্গে চুক্তির পর চাল সরবরাহ করছেন কিনা, তা তদারকি করতে বলা হয়েছে। গুদামে চাল মজুদের হালনাগাদ তথ্য জানতে চেয়ে খাদ্য অধিদফতর থেকে সব আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের গুদাম পরিদর্শন করে তারা সরকারি বিধান যথাযথভাবে পালন করছেন কিনা, তা যাচাই করা প্রয়োজন। লাইসেন্সের শর্ত মোতাবেক খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের নিয়মিতভাবে মজুদের হিসাব দাখিল নিশ্চিত করতে হবে। হিসাবের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য তাদের সংরক্ষণাগার পরিবীক্ষণ করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, দি কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট, ১৯৫৬-এর ক্ষমতাবলে লাইসেন্সের মাধ্যমে সরকার আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিককে ধান-চাল মজুদের সর্বোচ্চ পরিমাণ ও মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এর পরও এ নির্দেশ তারা সঠিকভাবে অনুসরণ করছেন না বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।

চাল আমদানি করা যাবে বিনা জমায় : চালের মজুদ তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় সঙ্কট মোকাবেলায় ‘শূন্য মার্জিনে’ ঋণপত্র খোলার সুযোগ দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ চাল আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলার সময় ব্যবসায়ীদের অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা থাকতে হবে না। তারা বাকিতে চাল আমদানি করতে পারবেন এবং চাল দেশে আসার পর ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারবেন। সরকার আপদকালীন সময়ে চাল আমদানিতে আমদানি শুল্ক বাতিলের কথাও ভাবছে বলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাল আমদানির এলসি খুলতে ব্যাংকগুলো এখন আর কোনো ‘মার্জিন’ ধার্য করতে পারবে না। চিঠিতে বলা হয়, সামপ্রতিক সময়ে হাওর এলাকায় বন্যা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবৃষ্টিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চালের স্বাভাবিক সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে বাজারে চালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে শূন্য মার্জিনে ঋণপত্র খোলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

আমাদানির ঋণপত্র খোলার সময় আমদানি মূল্যের একটি অংশ আমদানিকারককে ব্যাংকে জমা দিতে হয়। বাকি টাকা ঋণ হিসেবে ব্যাংক দেয়। কে কত ভাগ বহন করবে তা ঠিক হয় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পকের্র ভিত্তিতে।

চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই খাদ্যশস্য আমদানিতে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করে সরকার। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ যোগ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুণতে হয়। ফলে গত দেড় বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানি প্রায় বন্ধ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চাল আমদানিতে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ৫৪ দশমিক ১০ শতাংশ। আর এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬৩ শতাংশ।

কিন্তু এবার বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় সরকারি হিসাবেই হাওরে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হওয়ায় এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে (১০ টাকা কেজি দরের চাল) সাড়ে সাত লাখ টন চাল বিতরণ করায় সরকারি মজুদ তলানিতে নেমে আসে।

গতবছর এপ্রিলে যেখানে সরকারি গুদামগুলোতে সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি চাল ছিল, সেখানে এ বছর ১৫ জুনে তা ১ দশমিক ৯০ লাখ মেট্রিক টনে ঠেকেছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে চালের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় সরকারিভাবে মোট ছয় লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা করা হয়।

এর মধ্যে প্রথম দেড় লাখ টনের দরপত্র দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে আরও আড়াই লাখ টন আমদানির প্রস্তাবও সরকারের অনুমোদন পেয়েছেন। সরকার আশা করছে, আমদানি করা চাল দেশে এলে বাজারে দাম কমে আসবে।

ব/দ/প

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে