gulrokh-moni

প্র্রীণন জনপদ স্মৃতি অম্লান

ছায়া সুনিবিড় নদীঘেরা কাজীপাড়া গ্রাম। ও পথ দিয়ে হাঁটলে দেখা যায় ধেনু হাতে জাহানারা ছুটে চলেছে মাঠে। এদিকে তাকালে দেখা যায় মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজ আর সবুজ, কচি ধানের আগাগুলো দুলছে। জমিতে অনেক ফসল তোষাপাট, আলু,পটল, রাই সরিষা, তামাক আরও কত কি! নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে সাঁকো এর পিঠেই ভর করে গ্রাম্য কিশোরীরা পাঠশালায় যায়। মেঠো পথের ধারে মার্বেল খেলে ছোট ছোট ছেলেরা। জাম গাছে থোকা থোকা জাম, আম, আর জংলী ফলের সমাহার! গ্রাম্য বধুঁরা সারি সারি বসে কাঁথা সেলাইয়ে ব্যাস্ত, তালপাতার ঝুড়িও বুনতে পারে তারা। ব্রিটিশ শাসনামলে ‘নীল’ এর মিল ও ছিল এ গ্রামে। হিন্দু ও মুসলিম বাস করে এখানে কোন হিংসা বিদ্বেষ নাই। নদীর চরে লাগানো ধানের চারাগুলোর গাঢ় সবুজ রুপ দেখে স্নিগ্ধ হয় মন। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক বছরের পুরোনো বট আর ডেউয়া ফলের গাছ কি সুন্দর হলুদ হলুদ ডেউয়া ফল, পাকলে টক আর মিষ্টি লােগ বট গাছের লতাগুলো মাটিতে গেঁথে গেছে সেগুলো দেখে মনে হয়
এক একটি গাছ আর কিছু লতা মাথার উপরে ঝুলে আছে সেগুলো ধরে দোল খায় কিেশার -কিশোরী ও ছোটরা। বট ফল খেতে আসা পাখিগুলোর কিচিরমিচির মন্দ লাগে না। নদীর পানিতে বট ফল পড়া ঝুপ ঝুপ শব্দে ব্যাকুল হয় মন। দুরন্ত ছেলেরা গাছের ডালে উঠে নদীতে লাফ দেয় ঝপাস করে আবার উঠে গাছে, এভাবে কেটে যায় তাদের সারাবেলা। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে দিনমজুর মংলু চাচা বাঁশী হাতে চলে যায় বট গাছের তলায় গাছের মোটা মোটা শিকড়ে হেলান দিয়ে মনের সুখে সুর তোলে বাঁশীতে। বট গাছটিতে জ্বীন-প্রেতও ছিল, কিন্তু এর ছায়ায় প্রাণ জুড়াতে আসা গ্রামের মানুষের কলকাকলীতে আনন্দে উদ্বেলিত গাছের জীবজন্তুও।
নদীর ওপাশ দেখতেই মনটা ব্যাথায় কেঁপে ওঠে “যোদ্ধার ধার” এই পথ দিয়ে গ্রামে ঢুকেছিল পাক হানাদাররা জ্বালিয়ে দিয়েছিল বাড়ীঘর, হত্যা করেছে শিক্ষিত মানুষগুলোকে। বেঈমানের দল ঘাঁটি গেঁড়েছিল এই গ্রামে, নয় মাসের ছয় মাসই পার করেছে এখানে। গেরস্তের সকল গরু- ছাগল, হাঁস-মুরগী খেয়ে সাবাড় করেছে ওরা। গৃহিণীদের সদ্য হওয়া ভাতের হাঁড়িগুলো উল্টিয়ে দিতে বুক কাঁপেনি ওদের। উহ্ কি দূর্বীসহ দিন কেটেছে তাদের। এ গ্রামের সকল বাড়ী মাটির তৈরি চারটি দেয়াল থাকে মাটি দিয়ে ঘেরা আর এর উপরে বাঁশের চাটাই দিয়ে ছাদ পেটানো থাকে। উপরে থাকে দোচালা টিন অথবা খেড় এর ছাউনি। সাদা মাটির লেপনে চকচক করে দেয়ালগুলো। গরমকালে ঘরগুলো অনেক শীতল থাকে। সপ্তাহে দুইদিন বাজার বসে এ গ্রামে। নিত্য প্রয়োজনীয় সব পাওয়া হাটে। প্রতি বছর পৌষ মাসে মেলাও লাগে মেলায় যাত্রাগান, সার্কাস, পুতুলনাচ, চরকা, বড় বড় জিলাপির দোকান, আহ্ কতনা আনন্দ হয়।
গভীর রাতের শোনা যায় ভাওয়াইয়া গান” ওকি গাড়িয়াল ভাই……..” হ্যাঁ বাচ্চু ভাই গরুর গাড়ী করে মুরুব্বিদের বাজারে নিয়ে যায় প্রতিদিন আর আসে গভীর রাতে, চিরচেনা পথগুলো রাতের আঁধারেও ভুলে যায় না গরুগুলি। গাড়ী টেনে নিয়ে আসে বাড়ীর পথে। মাঝে মাঝে গাড়িয়াল বাচ্চু ভাই বলে হইট হইট ডানে চল ডানে…. এই যা, এই সুযোগে ভাওয়াইয়া তোলে গলায় বাহ্! কি চমৎকার সুর কোন গুরু ছাড়াই গানগুলোর সুর তোলে রেডিও শুনে শুনে। শুনেছি উত্তরাঞ্চলে “ইরি” ধানের চাষ প্রথম হয়েছিল এ গ্রামে। ফলনও মন্দ হয় না এই ধানের চাল বছর জুড়ে চলত বড় বড় গেরস্তদের আর গরীব চাষীরা বর্গা নেয় জমি, আর চাষ করে ‘ইরি’ তা দিয়েই তাদেরও মাস চারিক চলে। ধনী-গরীবদের মিল বন্ধনে শোভা পায় এ গ্রামের সৌন্দর্য। আধুনিকতার ছোঁয়ায় উত্তোরোত্তর উন্নয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে গ্রামের, শুধু নেই আগের মানুষগুলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে