কক্সবাজার: বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন্স, পাথুরে বিচ ইনানী, রামুর বৌদ্ধ বিহারসহ পর্যটনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি এই কক্সবাজারে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কক্সবাজারে চলছে তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি উন্নয়ন প্রকল্প।যা এক বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের মোট বরাদ্দ দেওয়া অর্থের দেড় গুণ।

যেখানে রয়েছে- রেললাইন, ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ,গভীর সমুদ্র বন্দর, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ২৫টি মেগা প্রকল্পসহ ৭৭টি বাস্তবায়নের কাজ চলছে। যা বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে কক্সবাজারের চেহারা।

এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পর্যটনে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। কক্সবাজার একদিন হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র। এই স্বপ্ন যেন বাস্তবে ধরা দেয় সেদিনের প্রতিক্ষায় পর্যটন রাজধানীর মানুষ।

অন্যদিকে, কক্সবাজার আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে, দেশি-বিদেশি পর্যটেকের পদচারনায় মুখর হবে, কক্সবাজারের জন্য সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে আর আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে বাংলাদেশ। কক্সবাজারকে ঘিরে সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু এই স্বপ্নের বাস্তবায়নেই যেন বর্তমান সরকার মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকমানের করা হচ্ছে। সাগর ছুঁয়ে কক্সবাজারে নামবে বিমান। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই ওঠানামা করবে বিমান। যেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পর্যটনখাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।

বেবিচক সূত্র জানায়, দেশে প্রথমবারের মতো সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর নির্মিতব্য এ রানওয়ে হবে দেশের সবচেয়ে বড়। এটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক বিকাশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে।

গত ২৯ আগস্ট ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কক্সবাজার বিমানবন্দরের এ রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা স্বপ্ন ও সরকারের নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

কক্সবাজারের পর্যটনের বিকাশ ও গভীরসমুদ্র বন্দর কেন্দ্রিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগও স্থাপন হচ্ছে। এক বছর পর এটি চালু হলে দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এতে করে পর্যটন শিল্পে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা।

কেবল যোগাযোগ অবকাঠামোই নয়, দেশের অর্থনীতির প্রধান গেম চেঞ্জার হিসেবে বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর-বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর মাতারবাড়িতে নির্মাণ হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। বাংলাদেশের প্রধান আমদানিস্থল চীনসহ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যে মেলবন্ধনের নিয়ামক হয়ে উঠবে জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে হতে যাওয়া মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর।

১৯৬২ সালে যখন কাশিমা বন্দর স্থাপনের কাজ শুরু হয়, তখন ওই এলাকাটি ছিল ধানক্ষেত। বন্দর নির্মাণের পর সেটি ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরও এমন বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, হংকংসহ দ্বীপভিত্তিক অর্থনৈতিক হাবগুলোর আদলে গড়ে তুলতে কক্সবাজার ঘিরে এক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার।  

আধুনিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেল সংযোগ, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বৈদ্যুতিক হাব গড়ে তোলার পাশাপাশি কক্সবাজারে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম দ্বীপভিত্তিক পর্যটন পার্ক। এছাড়াও কক্সবাজারকে ঘিরে চলমান রয়েছে বিমানবন্দর, রেললাইন, ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ২৫টি মেগা প্রকল্প সহ ৭৭টি বাস্তবায়নের কাজ। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি। যা এক বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের মোট বরাদ্দ দেওয়া অর্থের দেড় গুণ।

বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে সাবরাং, নাফ ও সোনাদিয়ায় হচ্ছে ইকো ট্যুরিজম- অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সমুদ্র নগরী এই কক্সবাজারে প্রতিবছর ৬০-৭০ লাখ পর্যটক ভ্রমণে আসলেও বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। তাই এবার বিদেশিদের আকৃষ্ট করতেই ঢেলে সাজানো হচ্ছে টেকনাফের সাবরাং, নাফ ও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ। সেখানে দেশে প্রথম দ্বীপভিত্তিক পর্যটন নির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি।

সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে থাকবে ৫ তারকা হোটেল, ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকুরিয়াম ও সি-ক্রুজ, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিশেষ ব্যবস্থা, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, ইকো-কটেজ, ওশেনেরিয়াম, আন্ডার ওয়াটার রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্টসহ নানা রকমের বিনোদনের সুবিধা। এছাড়া, টেকনাফ শহরের অদূরে নাফ নদীর মোহনায় জালিয়ার দ্বীপ ঘীরে নাফ টুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। মূলত বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে মালদ্বীপ, থাইল্যান্ডের মতো ইকো কটেজ, লাইফ এন্টারটেইনমেন্ট থিয়েটার, মেগা শপিং মল, সিনেমা হল, গলফ ক্লাব, ওয়াটার স্পোর্টস বিচসহ নানা আয়োজন থাকবে এই পার্কে। সন্ধ্যায় নিয়ন আলোয় থাকবে ক্যাম্প করার ব্যবস্থা। দেশে প্রথমবারের মতো কেবল কার যুক্ত হবে এই টুরিজম পার্কে। উপর থেকে পুরো দ্বীপের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে যাবেন পর্যটকরা। থাকবে ঝুলন্ত সেতুও।

এছাড়া, সমুদ্রদ্বীপ সোনাদিয়ায় ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বেজা। ৮৯৬৭ একর জায়গা জুড়ে ৯ বছর ধরে ধাপে ধাপে পার্কটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। সোনাদিয়া দ্বীপের মোট জমির পরিমাণ ৯৪৬৭ একর, যা ২০১৭ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন হতে বন্দোবস্ত নিয়েছে বেজা। এই দ্বীপে টুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে।

কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, কক্সবাজারে মেরিনড্রাইভ সড়ক হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং রেললাইন প্রওকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, ইকোনমিক জোনসহ তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগের কাজ চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আগামী ৫-৬ বছরের মধ্যেই অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হবে।  

কক্সবাজার সদর ও রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বাংলানিউজকে বলেন, এই কক্সবাজারকে ঘিরে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই কক্সবাজার হবে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরের মতো। এখানে বিদেশিদের জন্য করা হবে আলাদা জোন।

তিনি বলেন, কক্সবাজারে বর্তমানে তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। যা এক বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের মোট বরাদ্দ দেওয়া অর্থের দেড় গুণ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কক্সবাজারই হবে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন নগরী এবং অন্যতম অর্থনৈতিক অঞ্চল। তখন বিদেশিরা থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুর ভ্রমণে না গিয়ে আসবে কক্সবাজারে।

ban/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে