সিরাজগঞ্জ থেকে,মারুফ সরকারঃতাঁত পণ্যের বড়বাজার ঈদ। আর ঈদের বড় বাজার ধরে রাখতে তাঁত মালিকদের পাশাপাশি শ্রমিকদেরও এখন চোখে ঘুম নেই। তাই ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জের তাঁত পল্লীর তাঁতীরা। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তৈরি করা হচ্ছে নানা ধরনের নজরকারা বাহারী রঙের শাড়ী, থ্রীপিস, লুঙ্গি ও গামছা। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও কাজ করছেন সমান তালে। নারী শ্রমিকরা ঘরে সুতা পাকানো ও রং করা এবং শাড়ী প্রিন্টের কাজ করছেন। আর পুরুষ শ্রমিকরা তাঁতে শাড়ী লুঙ্গি গামছা তৈরীতে ব্যস্ত।

তাঁতের খট খট শব্দে মুখরিত এখন তাঁত পল্লী এলাকাগুলো। এখানকার তৈরি শাড়ী ও লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানী করা হচ্ছে। ঈদের বাকী কয়েকদিন নিরিবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, সুষ্ঠ বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে এই শিল্পকে রক্ষার দাবী জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানায়, তাঁত সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত উত্তর বঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ৫ লক্ষাধিক হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুম তাঁত রয়েছে। আর এসব তাঁতে ঈদ উপলক্ষ্যে এখন বিভিন্ন ধরনের বাহারী শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরি করছেন কয়েক লাখ তাঁত শ্রমিক। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, বেলকুচি, উল্লাপাড়া, চৌহালী ও রায়গঞ্জ উপজেলায় উৎপাদিত বাহারী সব শাড়ী ও লুঙ্গির সুনাম দীর্ঘদিনের।

ঈদকে ঘিরে তাই বাড়তি আয়ের আশায় তাঁত কারখানা গুলোতে শ্রমিকদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে অন্যান্য সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী। তাঁত শ্রমিকরা জানান, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মালিকদের চাপের পাশাপাশি নিজেদের বাড়তি আয়ের জন্য কাজের চাপ বেড়ে গেছে। তবে ঘন ঘন লোড শেডিং এর কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়, যার কারনে অনেকটা ক্ষতির সমুখীন হচ্ছেন তারা। তাঁতীরা জানান, এবারের ঈদে কাড়িয়াল, সম্বলপরী, অপরূপা, কানজি বরণ, অপেরা, কাতান, চোষা, জুট কাতান, জুট নেট, মসলিন, আঁচল পাড়, মেচিং জর্জেট, জাবেদ ডায়মন্ড এবং টিসু ডায়মন্ড, জামদানী, বুটিক,সুতি জামদানী এবং সিল্ক জামদানী শাড়ীর চাহিদা রয়েছে সবচেয়ে বেশী। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে দেশজুড়ে এসব কাপড়ের চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। ভারতে রয়েছে তাঁতের শাড়ী ও লুঙ্গির বিশাল বাজার।

এখানকার উৎপাদিত শাড়ী ও লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। বাহারী ডিজাইন ও রংয়ের এসব শাড়ী ৫’শ থেকে ২০ হাজার টাকা দামের এবং ৩’শ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা দামের লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। বেলকুচি সাহা পাড়ার তাঁত শ্রমিক সুভাষ জানায়, ঈদের সময় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মালিকদের চাপের পাশাপাশি নিজেদের বাড়তি আয়ের জন্য দিনরাত কাজ করছি । প্রতিপিস হিসেবে তাদের মুজুরী দেয়া হয় এতে করে তার প্রতিদিন ৪ শত থেকে ৬ শত টাকা মজুরী পেয়ে থাকেন। তবে ঈদের মৌসুমে কাজ বেশী থাকায় মুজুরীও বৃদ্ধি পায় বলে তিনি জানান।

তবে ঘন ঘন লোড শেডিং এর কারণে মাঝে মাঝে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। এসময় উৎপাদন বন্ধ থাকে যার কারনে অনেকটা আর্থিক ক্ষতির সমূখীন হচ্ছেন তারা। তিনি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবী জানান। শাহজাদপুর উপজেলার দ্বারিয়াপুরের তাঁত মালিক সিরাজুল ইসলাম জানান, ঈদকে সামনে রেখে কাজের ব্যবস্ত বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। রুচি এবং ডিজাইন পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের পণ্য উৎপাদন করতে হচ্ছে। নারী শ্রমিক রেহানা খাতুন বলেন, বছরের অন্যান্য সময় কাজ থাকলেও এই সময়ে কাজ বেড়ে যায় বহুগুণ।

দিনরাত কাজ করতে হচ্ছে তাতে মুজুরীও বেশী পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে সংসারের সচ্ছলতাও এসেছে। বেলকুচি’র জ্যোতি শাড়ীর মালিক বৈদ্যনাথ সাহা বলেন, ঈদ উপলক্ষে তাঁতী এলাকায় কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে। প্রতি বছরেই এসময় ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বছরের এই মৌসুমকে লক্ষ রেখেই ব্যবসায়ীরা উৎপাদন করে থাকেন। প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই পাইকাড়রা অর্ডার দিয়ে থাকেন এবং সেই মোতাবেক কাপড় তৈরী করা হয়। একই উপজেলার মুকন্দগাতী সাহাপাড়ার নিউ মাধবী শাড়ীর স্বত্বাধিকারি দুলাল সাহা বলেন, কম পুজির ব্যবসা আর নেই। রং সুতার দাম বেড়েছে। উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। মানুষের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। তাই কম দামের শাড়ী বাজারে চলে কম। গত দশ বছর আগে একখানা ভাল মানের জামদানী শাড়ী তৈরী করতে খরচ হতো এক থেকে দুই হাজার টাকা। কিন্ত এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার টাকা।

এতে করে তাঁিতদের পুজি খাটাতে হচ্ছে বেশী। কিন্ত সেই তুলনায় সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা নেই। ঢাকার ব্যবসায়ী আবু কায়সার জানান, এখানে উৎপাদিত কাপড়ের মান ভাল এবং দামও তুলনামুলক কম। যার কারনে প্রতি বছরই তিনি সিরাজগঞ্জের তাঁতের তৈরি শাড়ী ও লুঙ্গি ক্রয় করার জন্য আসেন। তিনি আরো বলেন, সারা দেশে এখানকার উৎপাদিত কাপড়ের চাহিদা থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তার মতো আরো শত শত পাইকাড়রা এসে কাপড় কিনে নিয়ে যান। সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি’র প্রেসিডেন্ট গোলাম আবু ইউসূফ সূর্য বলেন, সিরাজগঞ্জের তাঁতের শাড়ী ও লুঙ্গির চাহিদা দেশের সীমানা পেরিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। তবে তাঁত পণ্য সামগ্রীর বাজার নিয়ন্ত্রন নেই।

তাঁতিরা নিজ উদ্যোগে এই ব্যবসাকে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁতিদের ঋণের ব্যবস্থা নেই্। সেই তুলনায় সরকারি পৃষ্টপোষকতার অভাব রয়েছে। সিরাজগঞ্জের তাঁতের এই সাফল্য ধরে রাখতে সরকারের পৃষ্টপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি উৎপাদন ঠিক রাখতে নিরিবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবী জানান। এছাড়া তাঁত পণ্যের নিরাপদ বিপণন ব্যবস্থা এবং শ্রমিকদের নুন্যতম মুজুরী নির্ধারনেরও দাবী জানান তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে