বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনের সিসিটিভির ফুটেজ দেখে হামলায় অংশ নেয়া জড়িতদের নাম ও পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এরপর মামলা করা হবে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

এর আগে বুধবার (১৮ জুলাই) দিবাগত রাতে কয়েক দফায় এ হামলা চালানো হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ১৫-২০ জন পুলিশ সদস্য ও তিন আনসার সদস্য আহত হন। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদা আরেকটি মামলা করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ইউএনও মুনিবুর রহমান বলেন, হামলার ঘটনায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে সদর উপজেলা কমপ্লেক্সে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

প্রতক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার (১৮ আগস্ট) রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিটি করপোরেশনের লোকজন অনুমতি ছাড়া সদর উপজেলা কমপ্লেক্সে ঢুকে ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করতে শুরু করেন। এ সময় ইউএনওর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা তাদের পরিচয় জানতে চান। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। খবর পেয়ে ইউএনও ঘটনাস্থলে আসেন। বিষয়টি তিনি জানার পর সিটি করপোরেশনের লোকজনকে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রশাসনিক এলাকায় রাতে ব্যানার উচ্ছেদ বা অপসারণ অভিযান না চালাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করে অপসারণ অভিযান চালাতে থাকেন।

এসময় আনসার সদস্যদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে সিটি করপোরেশনের লোকজনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা যোগ দেন। এরপর সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে ক্ষিপ্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ইউএনওর সরকারি বাসভবনে হামলা করেন। এসময় হামলা থেকে রক্ষা পেতে আনসার সদস্যরা কয়েক রাউন্ড ফাকা রাবার বুলেট ছোড়েন।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হাসান আহেমদ ওরফে বাবুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সহসভাপতি আতিকুল্লাহ খান মুনিম, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব খান, সাজ্জাদ সেরনিয়াবাতসহ শতাধিক নেতাকর্মী সেখানে যান। এসময় নেতাকর্মীরা ইউএনওর বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। বাসভবনের গেট ভেঙে নিচতলায় ঢোকার চেষ্টা করেন।

সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে হামলাকারীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। একপর্যায়ে তারা পুলিশের ওপর চড়াও হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এ ঘটনায় পুলিশ ও আনসার সদস্যসহ অন্তত ৩০-৪০ জন আহত হন।

ইউএনওর বাসভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রহমান গাজী জানান, ব্যানার ও পোস্টার সকালে অপসারণ করতে বললে সিটি করপোরেশনের লোকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের খবর দিয়ে নিয়ে এসে ইউএনও স্যারের বাসভবনে ঢুকতে চেষ্টা করেন। এসময় বাধা দিলে তার মুখে একজন ঘুষি মারেন। তাদের হামলায় বাসভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তিন আনসার সদস্য ও স্থানীয় একজন আহত হন।

হামলার বিষয়ে ইউএনও মুনিবুর রহমান বলেন, উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে শোক দিবস উপলক্ষে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুকের ব্যানার-পোস্টার লাগানো ছিল। রাতে সিটি করপোরেশনের লোকজনের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসব ছিঁড়তে আসেন। রাতে লোকজন ঘুমাচ্ছে জানিয়ে তাদের সকালে আসতে অনুরোধ করা হয়। এ কারণে তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। কয়েকশ নেতাকর্মী রাত সোয়া ১০টায় বাসভবন ঘেরাও করে আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এরপর তারা আমার বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বাসভবনের গেট ভেঙে নিচতলায় ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন। বাসায় বৃদ্ধ বাবা-মা করোনায় আক্রান্ত। তারা বাবা-মাকেও গালাগাল করতে থাকেন।

তিনি আরও জানান, তাকে রক্ষা করতে আনসার সদস্য রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেন। তাদের গুলিতে ফারুক আহম্মেদ নামের একজন আনসার সদস্য আহত হন। এছাড়া তাদের হামলায় আনসার বাহিনীর জেলা অ্যাডজুটেন্ট আম্মার হোসেন ও বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রহমান গাজীসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

তবে হামলার বিষয় অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সাংবাদিকদের জানান, রাতে ব্যানার-পোস্টার অপসারণে সমস্যা কী জানতে ইউএনওর বাসভবনের দরজায় ঢুকতে গেলে আনসার সদস্যরা গুলি চালান। এরপর তারা ফিরে আসেন। কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে গুলি চালানোর কারণ জানতে আবার ইউএনওর বাসভবনে গেলে আবার গুলি করা হয়। এরপর পুলিশ এসে লাঠিচার্জ শুরু করে। গুলি ও লাঠিচার্জে প্যানেল মেয়রসহ অন্তত ২০-২৫ জন নেতাকর্মী আহত হন।

ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত সাংবাদিকদের জানান, সেখানে গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। কিন্তু আনসার সদস্যরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছেন। এতে অন্তত ৩০ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গাজী নইমুল ইসলাম লিটু সাংবাদিকদের বলেন, ইউএনওর বাসায় কেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ হামলা চালাবে? ইউএনও নিজে সিটি করপোরেশনের লোকজনকে কাজে বাধা দেন এবং অশোভন আচরণ করেন। তার প্রতিবাদ করলে আনসার সদস্যরা গুলিবর্ষণ করেন।

এদিকে রাত ২টার দিকে ইউএনওর বাসায় যান বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল হাসান বাদল, বরিশাল মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান, র‌্যাব-৮ এর অধিনায়ক জামিল হোসেন, বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, পুরো বিষয়টি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যারা অন্যায় করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ফজলুল করিম জানান, ইউএনওর অফিস ও বাসভবন সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা ঠিক হয়নি।

তিনি আরও জানান, ঘটনাস্থল থেকে মাহমুদ হাসান বাবু নামের একজনকে আটক করা হয়েছে। সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি পুলিশের ওপর হামলা ও দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার অভিযোগে পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক আরেকটি মামলা দায়ের করা হতে পারে।

Jag/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে