সাম্প্রতিক সংবাদ

শিমুল আলুতে ভাগ্য বদল

3_129168

বিডি নীয়ালা নিউজ(২৪জানুয়ারি১৬)- কৃষি প্রতিবেদনঃ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া গ্রামের আফাজ উদ্দিন (৬৫)। অভাবের কারণে ১৯৮৯ সালে নিজ গ্রাম ছেড়ে উপজেলার পাহাড়িয়া অঞ্চল গারোবাজারে চলে যান। চরম অভাবের মুখে বন বিভাগের সামান্য জমিতে গড়ে তুলেন নিজের বসত ভিটা। সেই থেকে স্থানীয় গারো আদিবাসিদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন শিমুল আলু (ক্যাসাভা) চাষে। সেই আফাজ উদ্দিন এখন স্বাবলম্বী, সফল শিমুল আলু চাষি। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আফাজ উদ্দিনের সংসারে এখন আর অভাব নেই। ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। সংসার খরচ চালিয়ে প্রতি বছর এখন প্রায় দশ লক্ষ টাকা আয় থাকে তার। শিমুল আলুই তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে।

এ বছর ঘাটাইল সেনানিবাসের আওতায় তিনশত একর এবং পাশ্ববর্তী ভালুকা উপজেলায় একশত একর জমি লিজ নিয়ে আলু লাগিয়েছেন আফাজ উদ্দিন। এর জন্য তার একর প্রতি লিজ মূল্য দিতে হয়েছে দশ হাজার টাকা করে।

আফাজ উদ্দিন জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। এবার একর প্রতি ৭ টন থেকে সাড়ে সাত টন আলু পাওয়া যেতে পারে। সরাসরি কোম্পানির কাছে তার আলু বিক্রি করা যায়। রহমান ক্যামিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড ও ভরসা ক্যামিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড এ বছর প্রতি মণ আলুর দাম নির্ধারণ করেছে ২শত ৮০ টাকা। আলুর দাম আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে জানান আফাজ উদ্দিন।

আফাজ উদ্দিনের মত অনেকেই এখন ঘাটাইল ও মধুপুরের পাহাড়ে বাণিজ্যিক ভাবে শিমুল আলুর বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেছে। শিমুল আলু চাষে তাদের উৎসাহ যোগাচ্ছে রহমান ক্যামিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড, ভরসা ও প্রাণ ক্যামিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড নামে কিছু প্রতিষ্ঠান।

মধুপুর উপজেলার চালা গ্রামের অপর ক্যাসাভা চাষি আব্দুস ছামাদ (৪৫) জানান, তিনি প্রাণ কোম্পানির অধীনে ৪৪একর এবং রহমান ক্যামিক্যাল কোম্পানির অধীনে ২৬ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। শ্রমিক মুজুরি ও বিপণন খরচ বাড়লেও কোম্পানি গুলো আলুর মূল্য বাড়ায় নাই। আশা করছি এবারও ভাল মুনাফা পাব।

রহমান ক্যামিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড’র সাগরদিঘি প্রজেক্ট এর এরিয়া ম্যানেজার এ এস এম ছাইদুল হক পরাগ বলেন, সারা বাংলাদেশে তাদের ছয়টি প্রজেক্ট রয়েছে। সাগরদিঘি প্রজেক্টের অধীনে ঘাটাইল, মধুপুর, ফুলবাড়িয়া ও সখিপুর উপজেলায় পাঁচশত একরের বেশি জমিতে এ বছর শিমুল আলু চাষে চাষীদের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। চাষিদের প্রতি একরে পনর হাজার টাকা করে দাদন দিয়ে উৎসাহ প্রদান করে কোম্পানী। পরবর্তীতে আলুর মূল্য থেকে টাকা কেটে নেয়া হয়। ভরসা ও প্রাণ ক্যামিক্যল কোং লিমিটেড এ অঞ্চলে একই ভাবে আলুর চাষে সহায়তা করছে। নিজেদের কৃষিবিদ দ্বারাই আলু চাষে চাষীদের সহায়তা করা হয়।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভাবে ক্যাসাভার চাষ শুরু হয় সাম্প্রতিক কালে। ক্যাসাভার আগমন ঘটে মূলত ১৯৪০ সালের দিকে। কিন্তু বৃহত্তম ময়মনসিংহ ও মধুপুরের আদিবাসী দের কেউ কেউ মনে করেন দেশীয় জাতের ক্যাসাভা অনেক পূর্ব থেকেই আমাদের দেশে পারিবারিক ভাবে আবাদ হতো। এ ক্যাসাভা অত্যন্ত শক্তিশালী একটি খাবার যাতে শর্করার মাত্রা উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের দেশে গাছটি শিমুল আলু হিসাবে বেশ পরিচিত। ক্যাসাভা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম শর্করা উৎপাদনকারী ফসল।

বর্তমানে বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়, হালুয়াঘাট, ফুলবাড়িয়া, সখিপুর মধুপুর, ঘাটাইল, নেত্রকোণা, লালমাই পাহাড় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিরা স্থানীয়ভাবে ক্যাসাভা চাষ করে। তবে রহমান ক্যামিক্যাল এন্ড কোম্পানি ছয়টি প্রজেক্টের মাধ্যমে, ঘাটাইল, মধুপুর, ময়মনসিংহ, চিটাগাং এর ফটিকছড়ি, মানিকছড়ি, করের হাট এবং কুমিল্লায় ব্যাপক ভাবে ক্যাসাভার চাষ হচ্ছে। বর্তমানে ‘ভরসা ক্যামিক্যাল কোম্পানি’ এ সব অঞ্চলে ফিলিপাইন হাইব্রিড জাতের ক্যাসাভা চাষ শুরু করেছে বলে জানান চাষীরা।

জানা যায়, ক্যাসাভা (Monihot Esculenta ) বহুবর্ষজীবী গুল্ম শ্রেণীর গাছ। ক্যাসাভা গাছের শিকড় জাত এক ধরণের আলু। জন্মে মাটির নিচে। নানা ভাবে ও পদ্ধতিতে এ আলু খাওয়া যায়। অনাবাদি পতিত অনুর্বর জমিগুলো সাধারণত এ আলু চাষের জন্য নির্বাচন করা হয়। অথচ এ আলু চাষে মাটির উর্বরতা কমেনা। ক্যাসাভা গাছের গিটযুক্ত কান্ড গুলো ছয় থেকে আট ইঞ্চি করে টুকরা টুকরা করে সারিবদ্ধভাবে জমিতে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে রোপণ করা হয়। আলু তোলা হয় অক্টোবর হতে নভেম্বর মাসের মধ্যে। গাছ লাগানোর সাত মাস পর আলু খাওয়ার উপযোগী হয়। এ আলু উৎপাদনে কোন খরচ নেই বললেই চলে। সার কীটনাশক লাগেনা। গাছ ছোট অবস্থায় দু’এক বার জমির মাটি উর্বর করে দিলেই চলে। এ আলুর পাতা বিষাক্ত বলে কোন প্রাণি এ গাছের পাতা খায়না।

বর্তমানে ‘রহমান ক্যামিক্যল এন্ড কোম্পানি’ প্রাণ ক্যামিক্যাল কোম্পানি এবং ‘ভরসা ক্যামিক্যল কোম্পানি’ স্থানীয় ভাবে এজেন্ট নিয়োগ করে ক্যাসাভা চাষে কৃষকদের মাঝে শর্ত সাপেক্ষে টাকা দিচ্ছে। ঘাটাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. নূর আলম বলেন, ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়ি অনাবাদি জমিতে সম্প্রতি ক্যাসাভার চাষ শুরু হয়েছে। যেহেতু এ আলুর চাষ নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে হয় সেহেতু চাষীরা আমাদের কাছে কোন সহযোগিতা চায়না। সহযোগিতা চাইলে আমারা তাদের সার্বিক সহযোগিতা করবো।

দেশীয় জাতের ক্যাসাভার মূল বা শিকড় আগুনে পুড়ে মিষ্টি আলুর মতো খাওয়া যায়। আলু সিদ্ধ করে বিভিন্ন তরকারির সাথেও রান্না করে খাওয়া যায়। এ ছাড়া শিমুল আলু থেকে তৈরি আটা ১০ থেকে ৩০ ভাগ গমের আটার সংগে মিশিয়ে রুটি, কেক, বিস্কিট, স্যুপ,ও রসগোল্লা তৈরি করা সম্ভব।

এ ছাড়াও ক্যাসাভা বা শিমুল আলু থেকে উৎপাদন হয়, গ্লুকোজ, লজেন্স তৈরির ম্যাটিচ্ছাল, পেস্ট, প্রসাধনি, ভিনেগার, সিরাপ তৈরির গ্র্যানিউল ইত্যাদি।

দেশের অনুর্বর পতিত জমিতে ক্যাসাভা চাষ করলে আমাদের খাদ্যের বাড়তি চাহিদা কিছুটা হলেও মেটানো সম্ভব বলে মনে করেন খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও চাষীরা। এ ছাড়া শিমুল আলুর বাণ্যিজিক মূল্যও কম নয়।

লেখক : এ কিউ রাসেল

সূত্রঃ কৃষিবার্তা

 

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinmail

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
shared on wplocker.com