দুই মন্ত্রী কামরুল ও মোজাম্মেলবিডি নীয়ালা নিউজ(২রা  সেপ্টেম্বর ২০১৬ইং)-ডেস্ক রিপোর্টঃ আদালত নিয়ে মন্তব্য করে অবমাননার দায়ে দ-িত দুই মন্ত্রী তাদের ‘সংবিধান রক্ষার শপথ ভেঙেছেন’ বলে জানিয়েছে আপিল বিভাগ।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে ছয় মাস আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে সাজা দিয়েছিল, সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে এ কথা উল্লেখ করেছে সর্বোচ্চ আদালত।

যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর চূড়ান্ত রায়ের আগে সর্বোচ্চ আদালতকে নিয়ে করা মন্তব্যের জন্য দুই মন্ত্রীর নিঃশর্ত ক্ষমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের আপিল বিভাগ গত ২৭ মার্চ ওই রায় দেয়। সেই রায় বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
রায়ে বলা হয়, ‘সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন রক্ষার যে শপথ বিবাদীরা নিয়েছেন, সেই দায়িত্বের প্রতি তারা অবহেলা করেছেন। তারা আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং সংবিধান রক্ষা ও সংরক্ষণে তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন।’
রায়ে আরো বলা হয়, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা (দুই মন্ত্রী) বিচার বিভাগের মর্যাদাকে খাটো করেছেন। তারা রায় প্রদান
প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে কুৎসা রটনা করেছেন। এটা মারাত্মক ফৌজদারি আদালত অবমাননা এবং সংবিধানে প্রদত্ত ব্যবস্থার লঙ্ঘন। এ কারণে তারা সহানুভূতি পেতে পারেন না। এজন্য তাদের নূ্যনতম সাজা দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে হওয়া এই রায় লিখেছেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এর মধে?্য বিচারপতি ইমান আলীর সঙ্গে অপর চার বিচারপতি একমত পোষণ করায় তার লেখা রায়ই আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার রায়ের বিষয়ে বিচারপতি ইমান আলীর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।
অন?্যদিকে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. নিজামুল হক।
বিচারপতি সিদ্দিকী তার রায়ে বলেছেন, ‘আমি আমার ভাই মোহাম্মদ ইমান আলীর রায় পড়েছি। অবমাননাকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা এবং তাদের দেয়া দ-ের বিষয়ে দ্বিমত পোষণের কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। তবে অবমাননাকারীদের শপথ লঙ্ঘনবিষয়ক অংশের সঙ্গে আমি একমত পোষণ করতে পারছি না।’
কারণ তাদের (দুই মন্ত্রী) শপথ ভঙ্গ করার বিষয়টি এই আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল না। শপথ ভঙ্গের বিষয়টি তাদের নজরেও (নোটিশে) আনা হয়নি। যারা এখনো মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে তারা আদালত অবমাননা করেছেন কি করেননি_সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
এর আগে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে মন্ত্রী কামরুল ও মোজাম্মেলকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদ- দেয় আদালত। ওই অর্থ সাত দিনের মধ্যে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশে দিতে বলা হয়। পরে তারা সেই অর্থ পরিশোধও করেন।
উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির আদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর আপিল মামলা পুনরায় শুনানির দাবি জানান। ওই শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেলকে অংশ না নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। একই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হকও প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন।
আদালত অবমাননার রায়ে সর্বোচ্চ আদালত দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হকের শপথ ভঙ্গ হয়েছে উল্লেখ করায় তাদের আর পদে থাকার অধিকার নেই বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি বলেন, যারা সরকারের কোনো কর্মে নিয়োজিত তাদের যদি জরিমানা বা জেল হয়, তাহলে পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এই বিধান অনুসারে তাদের পদচ্যুত হওয়ার কথা। এখন কেউ যদি আইনের তোয়াক্কা না করেন, সেটা ভিন্ন কথা। শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ে বলা হয়েছে, শপথ ভঙ্গ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করার পরে সাংবিধানিক কোনো পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তির এক মুহূর্ত পদে থাকার নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার নেই।
এজন্য তাদের মন্ত্রিত্ব হারানোর বিষয়টি সংবিধানে স্পষ্ট নেই বলে অনেকের মন্তব্য এসেছে।
এই বিষয়ে শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের কোনো বিধান লঙ্ঘন হলে সেটার সাজা সংবিধানে বলে দেয়া নেই। সংবিধান অপরাধীদের আইন না। তবে ধারণাটা হলো, কেউ যদি কখনো সংবিধানের পদে থেকে সংবিধান লঙ্ঘন করে, তাহলে নৈতিকতা ও আইনের ভার মাথায় নিয়ে এই মুহূর্তে পদত্যাগপত্র জমা দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, এখানে যারা এই ধরনের পদে থাকেন, তারা আইনের তোয়াক্কা করেন না, সংবিধানের তোয়াক্কা করেন না। শেষদিন পর্যন্ত পদে বসে থাকেন।
মার্চের রায়ের পর নিশ্চুপ ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরও তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কামরুল এর আগে আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
তাদের নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, আইন ও সংবিধানে এ ব্যাপারে ওইভাবে কিছু বলা হয়নি। এটা জনমতের ওপর নির্ভর করে। তারা থাকতে পারবে কি না, জানতে হলে জনমত যাচাই করেন।
এই দুই মন্ত্রীর এখন পদে থাকা উচিত বলে মনে করেন কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি বলব না। রাষ্ট্রে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এম আমীর-উল ইসলামও।
এই রায়ের ফলে এই দুই মন্ত্রী তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী এম কে রহমান বলেন, এই রায়ের মূল বিষয় হচ্ছে, দুই মন্ত্রী গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। শপথ ভঙ্গের বিষয়টি এই মামলার বিবেচ্য বিষয় ছিল না। তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে একটা ফাইন্ডিংস এসেছে। কিন্তু তারা মন্ত্রী থাকতে পারবেন কি না, এমন কিছু বলা হয়নি। এটা তাদের সুবিবেচনা ও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
এর আগে গত ২৭ জুলাই রায়ের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেছেন, সরকারই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে বিষয়টা নৈতিকতার।
বৃহস্পতিবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি অ্যাটর্নি জেনারেলও।
দুই মন্ত্রীর পদে থাকা উচিত কি না- এ প্রশ্নে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এখন এটা তারা বলবে। তারা শপথ নিয়েছেন, আরও একধাপ এগিয়ে পরিষ্কার করতে হয় তাদেরকেই করতে হবে।
মার্চে রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, এটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যক্তিগত বিবেচনার ব্যাপার।
তার মতোই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, নৈতিকতার ব্যাপারটা যার যার নিজের ব্যাপার। সেটা আমাদের কিছু বলার নাই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে