করোনাভাইরাস সংক্রমণে থমকে গেছে সারাবিশ্ব। থমকে গেছে দেশ। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিশু, কিশোর, বয়স্ক থেকে শুরু করে কেউ রক্ষা পাচ্ছে না এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক বের হয়নি। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে অপ্রয়োজনে চলাফেরা না করে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।

প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তাররোধে দেশের অধিকাংশ এলাকা লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকার ঘোষণা করেছে সাধারণ ছুটি। সরকার বার বার বলছে অপ্রয়োজনে রাস্তায় বের না হয়ে ঘরে থাকতে। কিন্তু সরকারের এই আদেশকে অনেকেই তোয়াক্কাই করছে না। কেউ কেউ অপ্রয়োজনে রাস্তায় বের হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। মানছে না সামাজিক দূরত্ব।

যদিও সোমবারের (৪ মে) নতুন সরকারি নির্দেশনা অনুসারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে দোকান ও শপিংমল আগামী ১০ মে থেকে খুলবে। তবে তা বিকেল ৪টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে।এরফলে মানুষ কিছুটা ঘরের বাইরে বের হতে পারবে। তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে।

কিন্তু সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া যাদের এই সময়ে কিংবা এই সময়ের বাইরে যারা সরকারি এই আদেশ অমান্য করে অপ্রয়োজনে চলাফেরা কিংবা আড্ডাবাজি করবে তাদের জন্য রয়েছে দুঃসংবাদ। তাদেরকে ২০১৮ সালের সংক্রামক রোগ ও ১৮৮০ সালের পেনাল কোডের আইনের মুখোমুখি হতে হবে। ইতোমধ্যে সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সরকারি আদেশ অমান্যকারীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন লঙ্ঘন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। ইতোমধ্যে এই আইনের ক্ষমতা বলেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ‘পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

অপরদিকে সংক্রামক রোগ আইনের পাশাপাশি ১৮৮০ সালের দণ্ডবিধি আইনেও সরকারি আদেশ অমান্যকারীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এই আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডর বিধান রয়েছে। তবে দুই আইনে কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও মানবিক দৃষ্টিতে বর্তমানে আর্থিক জরিমানাটা করা হচ্ছে।

এ বিষয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন জাগো নিউজকে বলেন, যারা সরকারের লকডাউন ঘোষণাকে অমান্য করে অপ্রয়োজনে চলাফেরা করে তাদেরকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ২০১৮ সালের সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৪,২৫ ও ২৬ ধারায় ধারায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও ১৮৮০ সালের দণ্ডবিধির ১৮৮ ও ২৬৯ ধারায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আইনে কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও আমরা মানবিক দৃষ্টিতে জরিমানা করছি।

২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ২৪ ধারায় বলা হয়েছে-

২৪ (১) : যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেন বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসিবার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তাহার নিকট গোপন করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান ও নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপনের অপরাধ ও দণ্ড

আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে-

২৫ (১) যদি কোনো ব্যক্তি-

(ক) মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং

(খ) সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন,

তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদানের অপরাধ ও দণ্ড

২৬ ধারায় বলা হয়েছে-

২৬ (১) যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ২ (দুই) মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

শাস্তির বিষয় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনে যা রয়েছে

সরকারি কর্মচারী কর্তৃক আইনসঙ্গতভাবে জারিকৃত কোনো আদেশ অমান্য করার দণ্ড

১৮৮০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ১৮৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো আদেশ জারি করতে বিধিসঙ্গতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মচারী কর্তৃক জারিকৃত আদেশে তাকে কোনো বিশেষ কাজ হতে বিরত থাকার অথবা তার দখলাধীন বা পরিচালনাধীন কোনো সম্পত্তি সম্পর্কে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দান করা হয়েছে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ নির্দেশ অমান্য করে, তবে, যদি অনুরূপ অবাধ্যতার ফলে আইনসম্মতভাবে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তির বিঘ্ন হয়, বিরক্তি উৎপাদিত হয় বা ক্ষতি সাধিত হয় অথবা, বিঘ্ন, বিরক্তি বা ক্ষতির অনুষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তবে সে ব্যক্তি এক মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা দুইশত টাকা পর্যন্ত যেকোনো পরিমাণ অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে। এবং যদি অনুরূপ অবাধ্যতার ফলে মানবদেহ, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার প্রতি বিপদ অনুষ্ঠিত হয় কিংবা অনুরূপ বিপদ অনুষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় অথবা কোনো দাঙ্গা বা কলহ অনুষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে সে ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত যেকোনো পরিমাণ অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

কোনো কার্য দ্বারা জীবনের পক্ষে বিপজ্জনক কোনো রোগের সংক্রমণ ছড়াইতে পারে জানিয়াও অবহেলাবশত উহা করে তার দণ্ড

১৮৮০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ২৬৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বেআইনিভাবে বা অবহেলামূলকভাবে এমন কোনো কার্য করে যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোনো রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও তা করে, তবে-সেই ব্যক্তি ছয়মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

উল্লেখ্য, পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুসারে সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় অকারণে ঘোরাফেরা করা এবং সামাজিক দূরত্ব না মানার অভিযোগে একমাসে (২৯ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল) পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইগত ব্যবস্থা নিয়েছে। এসময় একজনকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।১০৮টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। নিয়ম না মেনে দোকান খোলা রাখার ঘটনায় ৩ হাজার ৩৫৬টি মামলা হয়েছে। এসময় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৯ লাখ ১২ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সবচেয়ে বেশি মামলা ও জরিমানা হয়েছে ঢাকা মহানগরে। এরপর রয়েছে খুলনা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও মৌলভীবাজার জেলায়।

J/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে