‘সরকারী চাকুরী হইলে কবর গেরান্টি

…………………রফিকুল ইসলাম প্রিন্স

চায়ের মজলিশে জামিল চাচার কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম। চাচা যৌবনকাল থেকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেছেন। তার মুখে সরকারি চাকরীর তারিফ শোনা কিছুটা হলেও আপত্তিকর। জামিল চাচার কথার প্রতিউত্তরে এহসান সম্মতি সূচক মাথা দুলিয়ে বললো- ‘এটা আপনি একখান খাটি কথা কইলেন চাচা।’ ‘হ এহসান, সারাজীবন এত কষ্ট কইরা কাজকাম কইরা কী হইলো?’ ‘ওইসব চিন্তা এখন আর মাথায় ধরেনা চাচা। তয় গাঁয়ের মুরুব্বীরা অহন সরকারি আমলায় বেশিই বিশ্বাসী। মাইয়্যা বিয়া দেওন থেকা শুরু কইরা সব কাজে অহন সবাই সরকারি আমলা খোঁজে।’ এহসানের কথা শুনে বিব্রত হলাম মনেমনে। আচমকা নাড়া দিয়ে উঠলো অতীতের কিছু যন্ত্রণা। মনে ফের বাজতে শুরু করলো একটি ঘর ভাঙার শব্দ। তীব্র বেদনাময় শব্দ! বুবু তখন দশম শ্রেণীতে পড়া শিক্ষার্থী। ক্লাসে তার রোল বরাবরই প্রথম তিনের মাঝে থাকতো। পড়াশুনা এবং হাতের কাজে সমান ভাবে পটু। সুন্দর চপলালক্ষ্মী একটি জীবনে হঠাৎ পড়লো কালো ছায়া। বাবা সাতপাঁচ না ভেবেই ঠিক করলো বুবুর বিয়ে। কারণ হিসেবে সবার সামনে দাঁড়করালো ছেলে সরকারী চাকুরীজীবী। সুতরাং, সোনার হরিন হারাবার মতো বোকামি বাবা অবশ্যই করবেন না। বুবু তখন পরীক্ষার্থী। আমার মনেআছে, বোর্ড পরীক্ষায় বসার জন্য কতটা আকুতি করেছিলো মানিষটা। কিন্তু তার আকুতির মূল্যটা কেউ রাখেনি। আরেহ, সরকারী চাকুরীজীবী বর থাকতে বউয়ের কেনো আয় করা লাগবে শুনি। আয় বাদ যাক, পড়াশুনাইতো করার প্রয়োজন নেই। বাবার ধ্যান ধারনা ছিলো অনেকটা এমন। তারাহুরোয় বুবুর বিয়েটা হয়ে গেলো নিজের বয়সের দুইগুণ বড়ো এক অফিসারের সঙ্গে। একটি সরকারী চাকুরী জোটাতে তার কতইনা খাটতে হয়েছে! বয়স বেড়েছে, মাথার চুল উঠেছে, আরো কত কি! সবশেষে চাকুরী মিললে সে লোক কি আয়েশ করবে না? এরপরেও আমরা সরকারী আমলাদের বলি দায়িত্বজ্ঞানহীন। এরা নিজেরাও ভুগেছে, যার ফলে জনগনদেরও ভোগায়। হাহ্! উঠে এলাম মজলিস থেকে। কিছু একটা ফেলে এলাম বোধহয়। মানিব্যাগ? হবে হয়তো। তবে তাঁড়া নেই তার খোঁজ করার। ওটা বরাবরই ফাকাই থাকে। বাড়ির উল্টোদিকে হাঁটছি। আর দু’মিনিট হাঁটলেই বুবুর কবর। জামিল চাচা ঠিক বলেছে- ‘সরকারি চাকরি কবর গেরান্টি।’ আহারে বুবু, আব্বা আম্মার অসাবধানতায় খোয়াতে হলো তোর প্রাণ। এতে কার কী হয়েছে বল তো? রাগে দুঃখে ঝুলিয়ে দিলি স্বত্বা, অথচ, যে এসবের জন্য দায়ী তার সুখের সীমা নেই। শুনলাম নতুন করে প্রমোশন হলো। ক্ষমা পেলো। টাকা আর ক্ষমতায় যে অন্যায়গুলো ধামাচাপা দেওয়া যায়, বাবা বোধহয় তা বোঝেনি। মানুষ ভাবে সমস্ত সুখ সরকারী চাকরিতে। আরাম আয়েশ করে, ঘুষ খেয়ে বাড়ি গাড়ি গড়ায় আভিজাত্য থাকলেও, নেই সম্মান আর শান্তি। বুবু যখন অন্তঃস্বত্তা, তখন তার উপর হওয়া নির্জাতনগুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পরকিয়া এবং ডিভোর্সের যন্ত্রণা বুবুকে ছিড়ে ছিড়ে খায়। ক্ষমতার উল্টোপিঠে ধামাচাপা পড়ে যায় নির্জাতনের চিত্র। সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তার ক্যারিয়ারে এসকল বিষয়গুলো প্রলেপ লাগাতে পারেনা। ক্ষমতার অপব্যাবহারে নুইয়ে দেয় সমাজ এবং পরিবার। অতঃপর, ঘটে যায় একটি মৃত্যু। যেটা লিখা হয়েছিলো বুবুর নামে। গর্ভের সন্তান নিয়েই পরোপারে পাড়ি জমায় মানুষটা। অপরদিকে খুনির তৈরি হয় আরো একটি সংসার। সুনেছি অল্প বয়ষ্কা নারী, দেখতে সুন্দরী। বাকিটা ভবিষ্যতে শোনা যাবে। বাবা এখন প্যারালাইজড। বড়ো ভাই নিজের সংসার নিয়ে বেশ ভালোই আছে। এদিকে দিনভর টিউশন আর রাতভর বিসিএস প্রস্তুতির বেড়াজালে আটকে গেছে আমার জীবন। আগাগোড়া মিলিয়ে সেই এক দশা, সরকারী চাকরি! বুবুর কবর জিয়ারত করে মসজিদ প্রাঙ্গনে বসে আছি। মাগরীবের ওয়াক্ত এখন। সাদা পায়রাগুলো মাটি ঠুকরে খাবার খোঁজে। দৃশ্যটা বড়োই সৌন্দর্য! এমন কত একলা দিন আমার কেটে যায় অনিহায়। অনিহা বরাবরই নিজের প্রতি, নিজের জীবনের প্রতি। বুবু মারা যাবার পর থেকে বাবা মা’কে মানসিক শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছি। অথচ, আমি কতটা মানসিক অসুস্থতায় ভুগছি সে খবর কেউ রাখেনি। রাখার প্রয়োজন বোধকরি কারো নেই। ঠিক তিন বছর আগে রীমার চলে যাওয়াটা আমাকে আজও ভেঙ্গে রেখেছে আগাগোড়া। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সবে জয়েন করেছি তখন। এর মধ্যেই রীমার বাড়ি থেকে আসা বিয়ের প্রেশার। সাতপাঁচ না ভেবে মাকে পাঠালাম ওদের বাড়ি। রীমার বাবা সেদিন স্রেফ জানিয়ে দিলো, কোনো বেসরকারি চাকুরীজীবী ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে না। মা ফিরে এসে শুধু একটি কথা বলেছিলো- ‘রীমার বাবা ঠিক আমাদের মতো করেই ভুল করছে!’ মায়ের কথা শুনে কিছু বুঝতে বাকি রইল না। নতুন চাকরীটা সেবার ছেড়ে দিয়েছিলাম শুধু মাত্র রীমার বাবার শর্ত পূরণের জন্য। শুরু করলাম বিসিএস প্রস্তুতি। কিন্তু খুব একটা কাজে দেয়নি সেই ত্যাগ। সবর করতে পারেনি মানুষগুলো। দু’মাসের মাথায় রীমাকে তুলে দেয় এক সরকারী চাকুরীজীবীর হাতে। সে থেকে আজো চলছে আমার যুদ্ধ! কোনো স্বার্থ ছাড়াই নিজের সাথে যুদ্ধ করাটা বোকামো বটে। তবুও করিছি, রাগ আর জেদ মানুষকে আমার মতোই গড়ে বোধহয়। তিন তিনটি বিসিএস দিয়েও কিচ্ছু হয়নি। এদিকে আয়ু ফুরোচ্ছে, দিন বাড়ছে, সাথে দায়িত্বও। অপরদিকে ভালোবাসা ভালো আছে অসুন্দরতম রাজ্যে। এই সমাজের জীবনগুলো বড্ডো একঘেয়ে হয়ে গেছে। সবার চাহীদা, চাওয়া পাওয়া গুলোও এক হয়ে গেছে। জীবনে বৈচিত্র আসার বদলে এসেছে গ্লানি। কেউ বোঝে তো কেউ বোঝে না। সমাজের চিত্র পাল্টে গেছে ঢেড় আগে। এখনো কেউ সজীবতা খোঁজে, কেউ বা খোঁজেই না!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে