বাংলাদেশ বিমানকে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাত্রী সেবার মান উন্নত করার মাধ্যমে জাতীয় পতাকাবাহী বিমানের সুনাম বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশাকরি, বিমানের সুনাম অক্ষুণœ রাখা এবং উত্তরোত্তর যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি করা, এবং যে বিমানগুলো আমরা এনে দিচ্ছি সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের দায়িত্ব। কাজেই এটা নিজস্ব সম্পদ, সে কথা মনে রেখে আপনাদের কাজ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আজ অপরাহ্নে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের তৃতীয় বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ‘গাংচিল’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে একথা বলেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রনালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রেও আমি সকলকেই বলবো- আপনারা আপনাদের আন্তরিকতা নিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই কাজটি সম্পাদন করবেন।’
তিনি বলেন, আজকে দেশ যদি উন্নত হয়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, দেশের অগ্রযাত্রা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সকলেই সুন্দর জীবন পাবে, সুখী হয়ে চলতে পারবে। আর সেটাই আমাদের লক্ষ্য ।
দেশের বিমান বহরে তাঁর সরকার সংযোজিত অত্যাধুনিক বিমানগুলোর প্রতি সকলকে যতœবান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি অনুরোধ করবো আমার ‘গাংচিল’ যেন ডানা মেলে উড়তে পারে ভালভাবে, সবাই যতœ নেবেন।’
তিনি বলেন, আজকের উদ্বোধন করা ‘গাংচিল’কে নিয়ে বোয়িং এর সঙ্গে চুক্তিকৃত ১০টি বিমান ক্রয়ের মধ্যে ৯ নম্বর বিমানটি বহরে যুক্ত হলো। আর একটা আসলেই ১০ম টি পূর্ণ হবে।
অচিরেই এই বিমানগুলো ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে চলাচল করবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় এখনও আমরা যেতে পারছি না, তবে, আশা করছি শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের ড্রিমলাইনার সরাসরি ঢাকা থেকে জেএফকে (জনএফ কেনেডি এয়ারপোর্ট,নিউইয়র্ক) যাওয়ার মত সক্ষমতা রাখে। কাজেই আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’
সেই সঙ্গে লন্ডনে বিমানের জন্য স্লট যেন আরো বৃদ্ধি পায় এবং আরো কয়েকটি দেশে বিমান তার যাত্রীসেবা যেন বৃদ্ধি করতে পারে এবং যেতে পারে সরকার সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন সরকার প্রধান।
এয়ারক্রাফটের সংখ্যা বৃদ্ধিতে তাঁর সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘পরবর্তিতে আমাদের প্রয়োজন অনুসারে আমরা আরো বিমান ক্রয় করবো। তবে, এর মাঝে আমি আরো চাচ্ছি দুটো কার্গো বিমান আমাদের নেওয়ার জন্য। যাতে আমাদের আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পায়।’
তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই দুটি কার্গো বিমান কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে, এটাও ঠিক আমাদের দেখতে হবে কোথা থেকে ভাল পাওয়া যায়, ভাল দামে পাওয়া যায়-সেটাও আমাদের বিবেচনা করতে হবে।
উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী উড়োজাহাজটিতে আরোহণ করেন ও ককপিটসহ বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন এবং পাইলট ও ক্রুদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ উপলক্ষ্যে দেশ ও জাতির উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মুহিবুল হক, বিমানের বোর্ড অব ডিরেক্টরস’র চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) মুহাম্মাদ এনামুল বারী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও ক্যাপ্টেন ফরহাত হাসান জামিল স্বাগত বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রি পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিনবাহিনী প্রধানগণ, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ২০০৮ সালে মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং কোম্পানির ১০টি নতুন বিমান ক্রয়ের জন্য ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউএস ডলারের একটি চুক্তি করে।
ইতোমধ্যে বহরে যুক্ত হয়েছে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর, ২টি ৭৩৭-৮০০ এবং ৩টি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার।
‘রাজহংস’ নামের চতুর্থ ড্রিমলাইনারটি আগামী মাসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যুক্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সবক’টি ড্রিমলাইনারের নামকরণ করেছেন।
বাঙালি জাতির জন্যই অত্যন্ত কষ্টের, বেদনার মাস হিসেবে আগস্টকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ভাষণের শুরুতেই জাতির পিতা, ১৫ অগাস্টের সকল শহীদ, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহারা ২ লাখ মা-বোনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রতিষ্ঠান এবং ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলার সময়ই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিমান সংস্থা গড়ে তোলেন।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে ৩ বছর সময় পান, তাতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই তিনি করে দিয়ে যান। বন্ধু প্রতীম দেশগুলোর থেকে সহায়তা নিয়ে আমাদের বিমান এয়ারলাইন্স তিনি চালু করে দিয়ে যান।’
বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমান গাংচিল উদ্বোধন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ এই বিমান উদ্বোধনে এসেছি এই কারণে যে, আমার কেবলই মনে হয় একটু ভাল কাজ, যে কাজে আমার দেশের মানুষের কল্যাণ হবে, মানুষের মঙ্গল হবে, মানুষ স্বস্তি পাবে। সেই কাজটুকু করলে আমার বাবা-মা’য়ের আত্মা শান্তি পাবে এবং নিশ্চই তাঁরা খুশি হবেন।
জাতির পিতা বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্যমুক্ত করে উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার জন্যই আজীবন কষ্ট স্বীকার করে গেছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বে দরবারের বাংলাদেশ যেন একটু সম্মান নিয়ে চলতে পারে। বাঙালি জাতি যেন একটি সম্মানীত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
এ সময় স্বাধীনতা অর্জনকালে বাংলাদেশের সম্পর্কে বহিঃবিশ্বে প্রচলিত নেতিবাচক মনোভাবের প্রসঙ্গ স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘অনেকেই বলেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে কি হবে, এদেশ কখনও উঠে দাঁড়াতে পারবে না। আর ’৭৫ এর ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর সেই প্রচেষ্টাই নেয়া হয়েছিল।’
‘কাজেই ’৭৫ এর পর আমাদের জীবন থেকে মূল্যবান ২৯টি বছর হারিয়ে যায়, এটাই হলো দুর্ভাগ্যের কারণ যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দেশের স্বাধীনতাতেই বিশ্বাস করতো না,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘অথচ গত ১০ বছর এবং এর আগের ৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই আমরা একটি উন্নত অবস্থানে নিতে সক্ষম হয়েছি।’
তাঁর সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য সকলের উন্নত-জীবন-মানের নিশ্চয়তা বিধান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন,‘একদম তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকেও একটা সুন্দর জীবন যেন আমরা দিতে পারি সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি এবং বিমানকে আরো উন্নত করার দিকে সরকারের দৃষ্টি রয়েছে।’
এ সময় সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন এবং নতুন নতুন বিমানবন্দর তৈরিতে তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরেন তিনি।
’৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠনের সময়ই তিনি সিলেট এবং চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বোর্ডিং ব্রিজ নির্মাণ সহ আধুনিকায়নের করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার এখন কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরী করছে।
যেটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক গন্তব্যের পথে পড়ায় সেসব গন্তেব্যের মধ্যে চলাচলকারী বিমানগুলো এখান থেকে রিফ্যুয়েলিং এর সুযোগ পাবে এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বালুময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের সৌন্দর্যও পর্যটকরা আরো বেশি করে উপভোগ করতে পারবে, বলেন তিনি।
পর্যায়ক্রমে বিশ্বের অধিকাংশ গন্তব্যে যাত্রার জন্য বিমানের ফ্লাইট চালু সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ধাপে ধাপে বিশ্বের আরো অন্যান্য দেশে বিমান যেন যেতে পারে তার ব্যবস্থা আমরা করছি।’
বাইরে থেকে টাকা ধার না করে বিমান কেনার জন্য স্বাবলম্বি হওয়ার প্রতিও প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘অতীতের মত বিমান কেনার জন্য কারো মুখাপেক্ষী না থেকে, অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার না করে, নিজেদের ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়েই বিমান ক্রয় করবো। তাই ধাপে ধাপে আমরা এগুচ্ছি। অর্থাৎ আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে চাই এবং দেশকে জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলাদেশ বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলবে।’
তিনি এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, ‘জাতির পিতা আমাদের জন্য রক্ত দিয়ে গেছেন। তাঁর রক্তঋণ আমাদের শোধ করতে হবে।’

B/S/S/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে