nil2

বিডি নীয়ালা নিউজ(৬ই এপ্রিল১৬)- আসাদুজ্জামান সুজন(নীলফামারী প্রতিনিধি):  সময় হারিয়ে যায় অতীতের অদৃশ্য গহ্বরে। তবে সে শুধু চলেই যায় না, সৃষ্টি করে ইতিহাস। যুগে যুগে পৃথিবীর একেক মেরুতে গড়ে ওঠে মানুষের ভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি। বহমান সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয় দিনক্ষণ, কর্ম আর শিল্পের। তেমনি বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহনকারী একটি শিল্প মৃৎশিল্প। মৃৎশিল্প বলতে মাটি দিয়ে বাংলার কুমাররা হাতের নিপুণ স্পর্শে কারুকাজের মাধ্যমে যে শিল্পের সৃষ্টি করেছে তাকেই বুঝি। এর মধ্যে থাকতে পারে নিত্যব্যবহার্য পাত্র অথবা ঘর সাজানোর উপকরণ।

আমাদের পূর্ব পুরুষরা নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিকবস্তু হিসেবে মৃৎশিল্পের তৈরি থালা, বাসন, হাঁড়ি, পাতিল, ঘটি-বাটি ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন সময় এই শিল্প নানা রূপ রঙে আমাদের সামনে বৈচিত্র নিয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু সেই মৃৎশিল্পই বর্তমানে হারিয়ে যাবার পথে। একটা সময়ে মৃৎশিল্পের তৈজসপত্র রাজা, জমিদার ও অভিজাত পরিবারের নিত্য দিনের ব্যবহার্য বস্তু ছিল। সন্ধ্যা প্রদীপ কিংবা সকালের পান্তা-মরিচ খাওয়া পর্যন্ত এই শিল্পের প্রচুর ব্যবহার ছিল। প্রযুক্তির অগ্রগতি আর বিজ্ঞানের জয়ের ফসল হিসেবে কম দামে অধিক টেকসই অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন মেটাল সামগ্রীর দাপটে মৃৎশিল্পের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে।

তবে বাংলা নতুন বছরের এর চাহিদা একটু বেশি থাকে। আসছে নতুন বছর আসছে বৈশাখী মেলা। সেজন্য ইতিমধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কুমারপাড়া। এই পাড়ার প্রতিটি বাড়ির উঠোনে রোদে দেওয়া হয়েছে নরম মাটির তৈরি বিভিন্ন প্রকারের শিশু খেলনা। আর ঘরে বারান্দায় কিংবা ঘরের ভেতরে চলছে তৈরি করা খেলনার উপরে রংয়ের কারুকাজ। যার কিছু অংশ করছে নারী আর কিছু অংশ পুরুষ।

স্থানীয়ভাবে মৃৎশিল্পীদের কুমার বলা হয়। প্রাচীন কাল থেকে পাল সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই পেশাকে আপন করে নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রিক্ত হস্তে মৃৎশিল্পীরা পৈতৃক ভিটেমাটিতে বাপ দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে।

Nil

এবারের পহেলা বৈশাখ ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলায় পাল সম্প্রদায়ের মানুষ। তৈরি করছেন মাটির নানা ধরণের তৈজসপত্র। বছরের অন্য সময় অলস সময় কাটালেও, পহেলা বৈশাখ ঘিরে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন পাল সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা গড়ছেন মাটির গাছ, পাখি, ফুল, ফুলের টব, ব্যাংক, ফলমূল। আর এসব রং করারদায়িত্ব পেয়েছেন মৃৎশিল্পী সরস্বতী। স্প্রে মেশিনে মনের মাধুরী মিশিয়ে রং ছড়াচ্ছেন তিনি মাটির খেলনা গুলোতে। সৈয়দপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কি.মি দূরে চওড়া পালপাড়া গ্রাম। অবস্থান সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নে।

এই গ্রামের ৩০০ পরিবার মৃৎশিল্পীর কাজ করেন। মাটি এ কাজের প্রধান উপকরণ। পাশের চিকলী, যমুনেশ্বরী প্রভৃতি নদীর পলিমাটি সংগ্রহ করে গড়েন ওই পরিবারগুলো মাটির তৈজসপত্র, হাড়ি, কলসি, পিঠা তৈরির সরঞ্জামসহ কত কিছু। এর পাশাপাশি কেউ কেউ গড়েন খেলনা। মৃৎশিল্পীরা বলেন, খেলনা সামগ্রীর অনেক চাহিদা। বৈশাখী। মেলা, ঈদ, দুর্গাপূজা, মহররমের গ্রামীণ মেলায় এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। তবে পুঁজির অভাবে চাহিদা অনুযায়ী খেলনা তৈরি সম্ভব হয় না। সরস্বতী পাল বলেন, হাতে সময় নেই। সামনে পহেলা বৈশাখ, তাই ফুসরত কম।

সরস্বতীর স্বামী দীপক পাল বলেন, বৈশাখী মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রাম থেকে অর্ডার পেয়েছি। ৫ লাখ টাকার খেলনা নেবে তারা। এজন্য কুমারপাড়ার মানুষের ঘুম নেই। আমরা দুই মাস ধরে কাজ করছি। মাটি দিয়ে খেলনা তৈরি, পোড়ানো, রং করা এসব অনেক কষ্টের কাজ। দুই একদিনের মধ্যেই ট্রাক আসবে। ওই ট্রাকে চেপে চলে যাবে খেলনাগুলো চট্টগ্রামে। পালপাড়ার গোপলা চন্দ্র রায়ও খেলনা তৈরি করছিলেন।

ওই পাড়ার অজয় পাল বলেন, পুঁজি সংকটে আমাদের অনেকেই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু যদি এখানে ব্যাংকগুলো জামানতহীন ঋণ দেয়,তাহলে আমাদের তৈরি এসব খেলনা কেবল দেশে নয়, বিদেশেও বাজার পাবে। তিনি অারো বলেন, পালপাড়ার কুমারেরা ভালো কাজ করতে চায়। এবার বৈশাখে আমরা ৫ লাখ টাকার খেলনা বিক্রি করবো। প্রতিটি খেলনার পাইকারী দাম নিচে ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত। এজন্য অবশ্য পুঁজির যোগান দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকসহ কিছু কিছু স্বেচ্ছসেবী সংস্থা।

মৃৎশিল্পীরা শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। নকশা করা হাঁড়ি-পাতিল, চাড়ি, কলস, বদনা, খানদা, ফুলের টপ, ফুলদানী, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, সাজ-সজ্জা অলংকারসহ বাংলার চিরাচরিত সব নিদর্শন উঠে আসে সে শিল্পে।

তবে আশার কথা হল, শিল্প সচেতন ব্যক্তিরা মৃৎশিল্পের কদর করছেন বেশ। তাদের চাহিদায় শৌখিনতার অনুষঙ্গ হচ্ছে মাটির এসব পাত্র। মাটির তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে ঘরের শোভা প্রকাশ করছেন। সঠিক ব্যবহারে প্রশংসাও পাওয়াও কম না। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রেও এর ব্যবহার ভালো লক্ষ্যণীয়। মৃৎশিল্পের পণ্য ব্যবহার বাড়ানো গেলে দেশের কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে অনেক।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে