ডেস্ক রিপোর্টঃ ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে প্রচণ্ড জ্বর, বমি, গা ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শামীম আহমেদ। পরে জানতে পারলেন তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এরই মধ্যে হাতে-পায়ে ফুসকুড়ি কিংবা র‌্যাশ ওঠে, যা তাঁর ভোগান্তিকে দ্বিগুণ করেছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তাঁর প্লাটিলেট ৪০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। এ জন্য বিষয়টি খুবই মারাত্মক ছিল। ফলে তিনি একই সঙ্গে কোনো খাবার খেতে পারছেন না। যা খাচ্ছেন বমি হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে স্যালাইন দিয়ে তাঁর খাদ্য ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছেন চিকিৎসকরা। এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেমরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এমন লক্ষণই প্রকাশ পায়। আর এতে রক্তের কণিকাগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

সরেজমিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে রোগী ভর্তি হওয়ার কথা। সোমবার ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যালের মেডিসিন ওয়ার্ডে দেখা যায়, ৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন জ্বর নিয়ে। পরে সবাই জানতে পেরেছেন তাঁদের ডেঙ্গুতে আক্রান্তের কথা। মঙ্গলবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি মেডিক্যালে ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। আসগর আলী হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে দেখা যায়, ১১ জন ডেঙ্গু রোগী। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে ৪৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাসা ফিরে গেছেন। এ ছাড়া প্রতিদিন প্রায় চার-পাঁচজন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল, তবে ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। সে সময় মারা গিয়েছিল ১৪ জন। আর এ বছর জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যেই ১২ জন মারা গেছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর আশঙ্কা এখনো শেষ হয়নি। ডেঙ্গুর মৌসুম মূলত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত হলেও এবার এই প্রকোপ জানুয়ারি পর্যন্ত চলতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, এ বছরে মৃত ১২ জনের মধ্যে ৯ জন মারা গেছে ‘হেমরেজিক শক’-এর কারণে। ডেঙ্গু রোগের এই পরিস্থিতিতে রক্তক্ষরণ হয়। অনেকের মলের সঙ্গে রক্ত যায়। আট বছরের একটি শিশু জ্বরে ভোগার পরপরই মারা যায়। দুজন মারা গেছে ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’। এ পরিস্থিতিতে রোগী প্রবল জ্বরে অচেতন হয়ে পড়ে। মৃতদের মধ্যে চারজনের বয়স ছিল ১০ বছরের নিচে। একটি শিশুর বয়স ছিল এক বছর সাত মাস। একজন ছিলেন ২৭ বছর বয়সী চিকিৎসক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে চার হাজার ২৯১ জন। শুধু গত আগস্ট মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১৬৬৬ জন রোগী। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জুলাই মাস থেকে রাজধানীতে এ রোগের প্রকোপ দ্রুত বেড়েছে।

ডেঙ্গু প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা  ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘আক্রান্তের পর যেসব রোগীর ডেঙ্গুর হেমরেজিক অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাদের শরীরে আগে থেকেই ডেঙ্গু ইনফেকশন বিদ্যমান ছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকায় প্রতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। এ বছরের জানুয়ারিতে আগাম বৃষ্টি এবং সর্বশেষ অক্টোবরেও হালকা বৃষ্টি হওয়ায় মশার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপও বেড়ে গেছে।’ এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, তারা রাজধানীর ২২টি হাসপাতালের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের তথ্য নিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তদের হিসাব রাখছে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার ১৯টি এলাকাকে ডেঙ্গু বিস্তারে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল গত মে মাসে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, চিহ্নিত ১৯টি এলাকায় চিকুনগুনিয়াবাহক ও ডেঙ্গুবাহক মশার ঘনত্ব বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর জন্য দুই সিটির যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে, সেগুলোর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) আছে বনানী, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, গাবতলী, মগবাজার, মালিবাগের একাংশ, মিরপুর-১, মহাখালী ডিওএইচএস, নাখালপাড়া, পূর্ব শেওড়াপাড়া, টোলারবাগ ও উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টর। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ধানমণ্ডি ১, এলিফ্যান্ট রোড, গুলবাগ, কলাবাগান, মেরাদিয়া, মিন্টো রোড, বেইলি রোড ও শান্তিনগর। এসব এলাকার বাসিন্দাদের বিশেষ সতর্কতার কথা বলা হয়েছে।

বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ইমার্জিং ডিজিজ কর্মসূচির পরামর্শক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগ এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের (স্ট্রেইন বা সেরো টাইপ)। এগুলো হলো ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। ভয়াবহ বিষয় হলো, ডেন-৩ এবার দেখা যাচ্ছে, যা আগের বছরগুলোয় দেখা যায়নি। ডেন ৩-এ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এতে হার্ট, কিডনিসহ মাল্টি অরগান ফেইলিওর হয়। ফলে অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। এদিকে আক্রান্ত রোগীদের প্রচুর পরিমাণে রক্তের ঘাটতি দেখা যায়। তাই রোগীর স্বজনরা প্রায় প্রতিদিনই রক্তের খোঁজে ছুটছেন। ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তের অনুসন্ধানের বিষয়টি জানালেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঁধনের প্রচার সম্পাদক টিটু খান। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তের আবেদন আসে।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনালের ডা. শেখ সালাউদ্দিন বলেন, ‘ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে এরই মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এ জন্য নিয়মিত মশা নিধনও করা হচ্ছে।’ তিনি অনুরোধ করে বলেন, ‘এখন কারো এক দিনের বেশি জ্বর থাকলেই যেন সে চিকিৎসকের কাছে যায়।’

K/K/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে