…………………………মোঃ আবদুল মান্নান

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও রাজনীতিতে ইতিবাচক অর্জন অনেক কম। সংঘাত, সংঘর্ষ এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি এখন ও দেশে বিদ্যমান। রাজনীতিতে এককভাবে কৃতিত্বের দাবী করাটা এখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিত্যদিনের বক্তব্যের প্রধান বিষয়।  এখন রাজনৈতিক দলগুলোর যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতাই বেশী। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একরকম এবং ক্ষমতায় না থাকলে ভিন্ন রকমের মনোভাব রাজনীতিতে এখন লক্ষনীয় বিষয়। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে বিভিন্ন ধরণের ওয়াদা দেয়া এবং ক্ষমতায় আসার পর তা পূরণ না করা  এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতীত বিমূখিতা এবং ব্যক্তিস্বত্বার ভূঁয়শী প্রশংসা করার প্রবল মানসিকতা ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের নেতৃবৃন্দের প্রতিদিনের কার্যক্রমের প্রধান বিষয়। প্রত্যেক দলের অভ্যন্তরের নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটনাও  লক্ষণীয়। ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে আদর্শগত কর্মসূচী ও যুক্তির পরিবর্তে পেশি শক্তির ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে অধিকহারে। যে কারণে রাজনীতিতে পেশি শক্তির প্রদর্শনের প্রবণতা বেশী। ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক মূল দলের সাথে অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হচ্ছে এবং অধিকতর রাজনীতিপ্রবণ হয়ে উঠেছে ও ছাত্রদের মাঝে পেশাদার নেতৃত্বের বিকাশ প্রবণতা বেশী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে কারণে মুল দলে নেতৃত্বের উপর তাদের কর্তৃত্ব রাখার প্রত্যশার প্রবণতা এখন বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আর এ কারণে রাজনীতিতে এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সৎ, নিষ্ঠাবান ও প্রবীন রাজনীতিবিদগণ। অসৎ ও কালো টাকার মালিকদের বিভিন্ন দলে ঠাই দেয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো হচ্ছে। অসৎ রাজনীতিবিদ দ্বারা প্রভাবিত করা হচ্ছে রাজনীতির অঙ্গনকে এবং কলুষিত হচ্ছে রাজনীতি, এ- সব দূর্নীতিবাজ ব্যাক্তির দ্বারা। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মাঝে দূরত্ব বাড়ছে, নষ্ট হচ্ছে রাজনীতিতে সহনশীলতা, পারস্পারিক মর্যাদাবোধ এবং লাগামহীন অশালীন বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গণতন্ত্রের মূলধারা। মাঝে মাঝে রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্থ ও বাঁধাগ্রস্থ করেছে।

এ সময়ে জাতীয় সমস্যা সমাধানে বহির শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি এবং  জাতীয় মর্যাদা বারবার ক্ষুন্ন হয়েছে। এছাড়াও নির্বাচনকে ব্যয় বহুল করে এক শ্রেণীর রাজনৈতিক কর্মীর অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করণ, স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দূর্নীতিপরায়ণ আমলাচক্রের অশুভ আঁতাতের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনকে প্রভাবিত করণ ও তাদের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার হাতবদলে ভূমিকা পালনের সুযোগের প্রবণতা বৃদ্ধি দেশের রাজনীতিতে নানাভাবে কালো ছাঁয়া ফেলেছে। প্রধান প্রধান জাতীয় ইস্যুতে দলের বক্তব্য ও কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে জনগণের সমর্থন আদায় ও জনপ্রিয়তা অর্জনের পরিবর্তে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদাগার এবং প্রতিহিংসামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সময়ক্ষেপন করা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দের দ্বারা জাতীয় সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত না করে বিক্ষোভ, হরতাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচীর প্রবণতা বৃদ্ধি এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাাঁড়িয়েছে। সরকারী দলের ঘোষণা, বিরোধীদল হলে হরতাল না করা এবং সরকারী দল থেকে নির্বাচন হেরে বিরোধী দল হলে ঠুনকো অজুহাতে অঙ্গিকার ভূলে হরতাল করার চর্চা এবং বর্তমানে রাজনীতিক দলগুলোর এ সব সুবিধাবাদী নীতিগ্রহণ জনগণকে হতাশ করেছে। ক্ষমতা দখলের জন্য দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের কৌশল গ্রহনের মাধ্যমে জনগণের সাথে দায় এড়াতে অভিনব কৌশল অহরহ গ্রহণ করছে রাজনৈতিক দলগুলো, যা জনমনে বিরুপ প্রভাব ফেলছে।

এরপর রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভাগ্যগড়ার চেয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ার  প্রয়াস অব্যাহত রাখায় জাতিকে বিচলিত করলেও এসব রাজনৈতিক মহল তাতে মোটেই উৎকণ্ঠিত নয়। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও কালো টাকার মালিকদের সাথে রাজনীতি এবং প্রশাসনের অসাদু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ও প্রশ্রয়, পরিস্থিতির উদ্বেগজনক হারে অবণতিও সচেতন নাগরিক সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। এনজিও সাম্রাজ্যবাদ রাজনীতিতে অনেকটা প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অত্যস্ত সক্রিয় তৎপরতা পরিচালনা করছে দেশে। এনজিওগুলো চটকদার জনকল্যঠু মূলক কর্মসূচি ও দারিদ্র বিমোচনের নামে দেশে বিশাল বাণিজ্যসম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখন সুশীল সমাজ গড়ার পরিবর্তে বুদ্ধিজীবি মহলকে রাজনীতির গুটিতে পরিণত করছে।

বর্তমানে শিক্ষক ও ব্যবসায়ী সমাজ পযন্ত রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার। অন্ধভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরন এবং এর আগ্রাসন জাতিকে আদর্শিক দিক নির্দেশনাহীণতা এবং কান্ডারীবিহীণ তরীর মত লক্ষহীনতার দিকে ঠেলে দিয়ে আদর্শিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে নৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। নিজস্ব ঐতিহ্য বিছিন্নতা, জাতীয় জীবনে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ বিনষ্ট করছে যা থেকে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোর পরিবর্তে অর্থহীন, অযৌক্তিক রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানে ব্যন্ত থাকা  রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবিগণ এখনও  মুক্ত হতে পারেন নি।

দেশের অনেক মানুষ এখনও বস্তিতে বাস করছে, অনেক মানুষ গৃহহীন ও আশ্রয়হীন। বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, অতি অল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী মানুষের হাতে চলে গেছে দেশের বেশিরভাগ সম্পদ। বিভিন্ন কৌশলে বিদেশে পাচার হচ্ছে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক, বীমাসহ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক সুবিধা ভোগ করছে একদল সুবিধাভোগী, সুযোগ সন্ধানী স¦ার্থপর রাজনীতিবিদ, সরকারী আমলা ও বিত্তবান শ্রেণির মানুষ। যা থেকে ভয়ংকর এবং ভারসম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। শোষণ ও জুলুমের শিকার হচ্ছে দেশের অনেক মানুষ। আসাদু রাজনৈতিক নেতা ও আমলার মাধ্যমে মাদক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে দেশে, যা আইন শৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বাড়ছে নারী, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষনের মত ভয়ানক দূর্ঘটনা। মানবপ্রেম, শ্রোদ্ধা ও ভালবাসা দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। দেশে প্রায়সই ঘটে চলছে হৃদয় বিদারক হত্যাকান্ড ও পাশবিক অপরাধ। উল্লেখিত ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলেই মনে হয়, এসব বিষয় নিয়ে এখন সকলের ভাববার সময় এসেছে। উর্বর জমি ও প্রাকৃতিক জনসম্পদ সমৃদ্ধ সম্ভাবনাময় দেশ, আমাদের বাংলাদেশ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষের চিন্তাধারা অভিন্ন। এ সব মিলিয়ে বিরাজ করছে দেশে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ। ছোট খাটো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটেছে এর মধ্যে। সরকারী হস্তক্ষেপে যেগুলোর সুন্দর সমাধানের চেষ্টাও চালানো হয়েছে। কিন্তু সংকীর্ণ রাজনীতির যে কানা গলিতে আমরা বিচরণ করছি, সেটাই হয়ত আমাদেরকে অকল্পনীয় ক্ষতির দিকে নিয়ে চলছে। সেই অন্ধকার গলি ও সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে আমাদের অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে।

আগামী মার্চ ২০১৮ তে দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তাই আগামীতে আমাদেরকে আরও অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। ২০১৮ সালেই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। ৫ বছরের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে ভোটের মাধ্যমে। নির্বাচন প্রক্রিয়া হচ্ছে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার মাধ্যমে দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা ও দেশের জনগণের সিন্ধান্ত নেয়ার উপযুক্ত প্রক্রিয়ামাত্র। এ নির্বাচন যাতে প্রহসনের নির্বাচন না হয়, কোন রাজনৈতিক অশুভশক্তি যাতে গণতান্ত্রিকধারাকে ভূলুন্ঠিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসতে না পারে, এ জন্য জাতীয় স্বার্থে দলমত নির্বি শেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

দেশে রাজনীতির সুস্থ্যধারা চলমান রাখা এবং গণতন্ত্রের প্রতিটি স্তরে এর বাস্তবয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ক্ষমতাসীন দল। বিরোধী দলগুলোকেও ক্ষমতায় আসতে হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সরকারের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে গণতন্ত্র উন্নয়নের ধারা রক্ষার স্বার্থে ধৈর্য্যধারণ করে এগুতে হবে এবং গণতন্ত্রে গুণগত পরিবর্তন আনতে ও ক্ষমতায় থাকতে হলে সরকারী দলকেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি যত্নবান হতে হবে এবং তা বাস্তাবায়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। তা-হলেই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সৎ, নিষ্ঠাবান ও যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করা সম্ভব।

 

 

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে