মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার: ঢাকার পাশের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকে সারা দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। অনুরূপ নজর রেখেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ দেশের সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজও। নির্বাচনি প্রচারণা থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ, ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সকল কার্যক্রম অত্যন্ত সুন্দরভাবে সুষ্ঠুুুরূপে সম্পন্ন হয়েছে। এই নির্বাচনে দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য, সহনশীল রাজনীতির জন্য, রাজনীতিতে পরমতম সহিঞ্চুতার জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে।

অথচ দেশব্যাপী চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতা, সংঘাত, মারামারি, হানাহানি, হত্যাকাণ্ডের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনার বিপরীতে নারাণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ, সকল রাজনৈতিক দল, নির্বাচনে অংশ নেয়া সকল প্রার্থী যে সংযম, শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রেখে নির্বাচনের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তা পুরো দেশের মানুষের জন্য, সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জন্য এক অনুকরণীয়, শিক্ষণীয় বলে নিঃসন্দেহে বলা যায়।

একইসঙ্গে নির্বাচন পরবর্তীতে বিজয়ী প্রার্থী এবং পরাজিত প্রার্থী সমভাবে নির্বাচনি ফলাফল মেনে নেয়ার নজির দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। পাশাপাশি নির্বাচন পরবর্তী নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের বাসায় মিষ্টি নিয়ে উপস্থিতি, এ সময় তারা একে অন্যকে মিষ্টি খাইয়ে দেয়ার খবরও সারা দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমাদৃত, প্রশংসিত হয়েছে। রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা হচ্ছে এ নিয়ে। গণমাধ্যমেও এই খবরটিকে গুরুত্বসহ মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকাশ করেছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, নির্বাচনি প্রচারণা, নির্বাচনি ফলাফল, নির্বাচন পরবর্তী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে নারায়ণগঞ্জের মানুষ, নারায়ণগঞ্জের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীরা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে, নির্বাচনি ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কর্মাকাণ্ড, প্রচার-প্রচাণরায় কোথাও এতটুকু নেতিবচাক ঘটনা ঘটেনি।

যা কিনা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয়, ভোটার, প্রার্থীসহ অত্র এলাকার সকল স্তরের মানুষের মধ্যে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। নির্বাচনি মাঠে মেয়রসহ সকল কাউন্সিলর প্রার্থী তাদের কর্মী-সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী সবাই নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় প্রতিপক্ষকে নিয়ে, প্রতিপক্ষের কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনা, বির্তক, অভিযোগ, অনুযোগ থাকলেও তা কখনো সীমা ছাড়িয়ে যায়নি।

এই নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় কোথাও সহিংসতা, হাতাহাতি, মারামারি, এতে অন্যের পোস্টার ছেঁড়া, প্রচারাণায় বাধা দেয়া, নির্বাচনি অফিস ভাঙচুরের মতো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এসব ঘটনা মূলত গণতন্ত্রের জন্য, গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য, শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য অপরিহার্য। এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য অলঙ্কার ও অহঙ্কারের বার্তা বয়ে আনে।

পরাজিত মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের বাসায় মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে তিনবারের জয়ী প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৭ জানুয়ারি সোমবার বিকেল ৫টার দিকে শহরের মাসদাইর এলাকায় তৈমূরের বাসভবনে যান তিনি। এ সময় তার সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। বাসায় গিয়ে তৈমূরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আইভী। সম্পর্কে তৈমূরকে ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করেন তিনি। এ সময় কাকাকে মিষ্টি খাইয়ে দেন তিনবারের নির্বাচিত মেয়র। আইভীর মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেন কাকা তৈমূর।

সেলিনা হায়াৎ আইভির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে স্বতন্ত্র পরাজিত মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কটা পারিবারিক। নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে আমার সহযোগিতা সব সময় তার ওপর থাকবে।’ এ সময় আইভীর মাথায় হাত রেখে তৈমূর বলেন, ‘যেকোনো বিপদে আপদে অদৃশ্য শক্তির মতো তার মাথায় আমার হাত থাকবে।’ পরে নবনির্বাচিত মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘চাচার নির্বাচনি এজেণ্ডাগুলো আমি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবো। কাকা আমাদের অভিভাবকের মতো। আমাদের সম্পর্কটা পারিবারিক। কাকা ব্যস্ত থাকলে ফোনে কাকির সঙ্গে কথা হয়।’

এর আগে, রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নাসিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। তার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার। তার নির্বাচনি প্রতীক ছিল হাতি। ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণা করা হয়।

ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেছে, আইভী তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারের চেয়ে ৬৬ হাজার ৯৩১ ভোট বেশি পেয়েছেন। বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফলে আইভী পেয়েছেন এক লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। হাতি প্রতীকের তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৬৬ ভোট। সোমবার সকালে আইভী গণমাধ্যমকে জানান, তিনি সকালেই তৈমূর আলম খন্দকারের বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। তবে সকালে তিনি বাসায় ছিলেন না বলে সে সময় যেতে পারেননি।

নির্বাচনের আগে আইভী বলেছিলেন, ভোটে জিতলে তিনি মিষ্টি নিয়ে তৈমূর আলম খন্দকারের বাসায় যাবেন। এর আগে ২০১৬ সালে নাসিক নির্বাচনে জেতার পরও মিষ্টি নিয়ে ধানের শীষের প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের বাড়িতে গিয়েছিলেন আইভী। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী সোমবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকারের বাসায় মিষ্টি নিয়ে যান। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে তিনি শহরের মাসদাইরে তৈমূরের বাসায় যান।

আইভী তার তৈমূর ‘কাকাকে’ মিষ্টি মুখ করান। তৈমূরও তার ‘ভাতিজি’ আইভীকে মিষ্টিমুখ করান, মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন।
প্রসঙ্গত : তৈমূর আলম খন্দকার নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আইভীর বাবা আলী আহম্মদ চুনকার সঙ্গে আমার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। এই সম্পর্ক কখনো নষ্ট হবে না। আপনারা সবাই আইভীকে সহযোগিতা করবেন। আমার শ্রদ্ধা আলী আহম্মদ চুনকার জন্য আজীবন থাকবে। তার মেয়ে আইভীর পাশে সব বিপদ-আপদে আছি, থাকব। অদৃশ্য শক্তির মতো পাশে থাকব।’

প্রসঙ্গত : মেয়র নির্বাচন করতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টার পদ হারানো প্রবীণ নেতা তৈমূর বলেন, ‘এটা নির্বাচন ছিল। আমরা আগামীতে সুন্দরমতো থাকব। এখানে অন্য কথাবার্তা কাজে আসবে না। আমি আগেই বলেছি, আইভীর সঙ্গে আমার অন্তরের ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক।’ তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান মেয়রকে সহযোগিতা করার। বাবার সহযোদ্ধার কাছ থেকে এসব কথা শুনে টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত মেয়র আইভী বলেন, ‘ভবিষ্যতে কাজ করতে গেলে অবশ্যই তার (তৈমূর) পরামর্শ নেব।

আমি পৌরসভার মেয়র থাকাকালে তার কাছ থেকে অনেক পরামর্শ নিয়েছি। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকবে। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক বজায় থাকবে। রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি, কিন্তু পারিবারিক সম্পর্কের জায়গায় সম্পর্কটা থাকবে।’ হাতি প্রতীকের তৈমূরকে হারানো আইভী বলেন, ‘আমরা যে যেই দল করি না কেন, আমরা সবাই নারায়ণগঞ্জের মানুষ। আমরা একত্রে বসবাস করবো।’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মেয়র আইভী শুধু সমালোচনার জন্য সমালোচনা নয়, বরং সবার সহযোগিতা কামনা করেন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে দেশের সকল নির্বাচনে, রাজনীতিতে নারায়ণগঞ্জের মতো নির্বাচনি পরিবেশ, প্রচারণা, নির্বাচন পরবর্তী শান্তিপূর্ণ পরেবেশ বজায় রাখতে এই দৃষ্টান্ত অনুকরণ অনুসরণ করবেন সকল রাজনৈতিক দল, দলের নেতাকর্মী, সমর্থকরা। তাহলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। কারণ সহিংসতা, সংঘাত কখনো মানুষের জন্য, দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারেন না।।

লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: বাংলা পোস্ট | সদস্য ডিইউজে | আহবায়ক জাতীয় জনতা ফোরাম|

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে