সাব্বির আলম বাবু, প্রতিনিধিঃ বর্তমানে বিশ্ব আতংক প্রানঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও নানামূখী সমস্যায় জর্জরিত দ্বীপ জেলা ভোলা সহ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বর্ণ কারিগররা।

আবহমান কাল থেকে পৃথিবীর বুকে সকল নারীকূলের সৌন্দর্যের পূর্ণতা আনতে স্বর্ণালঙ্কার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শুধু নারীই নয় অভিজাত বংশ পরিচয়ের পদ-পদবীধারী পুরুষেরাও নারীদের পাশাপাশি স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার করতো।

এই স্বর্ণালঙ্কার এর প্রকৃত রুপ তথা নিপুন হাতের কারিগরি নির্মানের মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় আকার-আকৃতি লাভ করতে যারা প্রধান ভূমিকা রাখেন তাদেরকে বলা হয় স্বর্ণকার বা স্বর্ণের কারিগর।

সুদুর অতীত থেকে আজ অব্দি বংশ পরম্পরায় আমাদের দেশে স্বর্ণের পেশায় জড়িত অনেক মানুষ। বাহারী সব স্বর্ণালঙ্কার এর পসরা সাজিয়ে দোকানের সৌন্দর্য বাড়িয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এই সব দোকানকে জুয়েলারি দোকান বলা হয়।

দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় কারিগররা তৈরী করেন নানা ডিজাইনের বাহারী রকমের সব গহনা। অনিমা জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী কমল স্বর্নকার বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে এ পেশায় এসেছি।

বাবার কাছ থেকেই এ পেশার খুটিনাটি শিখেছি। আগে ব্যবসার অবস্থা ভালো থাকলেও বর্তমানে করোনা কালীন এই সময়ে বাজার লক ডাউন ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম উঠানামা করায় ব্যবসার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে অন্যান্য ব্যবসার সাথে সাথে স্বর্ণ ব্যবসায়ও এসেছে ডিজিটালের ছোঁয়া।

বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা হাতের তৈরির পাশাপাশি ইদানিং মেশিনেও তৈরী হচ্ছে। তাছাড়া স্বর্ণের পরিমাপের জন্য রতি, আনা, ভরি ইত্যাদি আগের দাঁড়িপাল্লার পরিবর্তে এখন ডিজিটাল মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। সাধারনত বাঙ্গালীর বিভিন্ন উৎসব যেমন- বিয়ে, জন্মদিন, পুঁজা-পার্বন, ঈদ ইত্যাদি অনুষ্ঠান আসলে স্বর্ণকারদের চাহিদা বেড়ে যায়।

সাধারনত নানা ডিজাইনের গহনা যেমন- গলার হার, নাক-কানের দূল, মাথার টিকলি, বালা, চুড়ি, বিছা, সান্তাহার, মান্তাসার, ব্রেসলেট, আংটি ইত্যাদি এই সময়ে স্বর্ন কারিগররা তৈরী করেন। কখনো আবার সেগুলোর উপর নিখুঁত ভাবে বসানো হয় মূল্যবান রঙ্গিন পাথর।

এ সকল গহনা তৈরীতে কারিগররা নানারকম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। যেমন- খুন্তি, চিমটা, গ্যাস, সালফার, তেলের প্রদীপ, পাস, লাইট ইত্যাদি। স্বর্ণকাররা মাঝে মধ্যে ক্রেতা থেকে ব্যতিক্রমী অর্ডারও পান।

যেমন- খেলাধূলা- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ক্রেষ্ট তেরী, রুপার চাবির রিং, তাবিজ, মেডেল ইত্যাদি। শিশির জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী বাবুল স্বর্ণকার বলেন, আমাদের বয়বসা গ্রামের কৃষকদের নিয়ে। গহনা তেরীর বর্তমান ডিজিটাল যন্ত্রপাতি দাম অনেক বেশী হওয়ায় এবং সে অনুপাতে অর্ডার ও বেচা কেনা কম থাকায় কিনতে ও কারিগরদের ন্যায্য মুজুরী দিতে পারছিনা।

সীতাহার, মান্তাহারের মতো স্বর্ণালঙ্কার তৈরী করতে একজন কারিগরের কম পক্ষে পাঁচ থেকে সাত দিন লাগে।

অথচ তারা এজন্য এখনো দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা মুজুরী পান। তাছাড়া কাজ ও অর্ডার আগের মতো থাকলে অবশ্য পুষিয়ে নেয়া যেতো। একাধিক স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জানান, স্বর্ণের দেশী বাজারে মন্দার অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম উঠানামা করায়।

বর্তমান আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় টিকতে পারছেন না সনাতনি ডিজাইনের স্বর্ণের কারিগরেরা। বাজারে ইমিটেশন, সিটিগোল্ড সহ অন্যান্য দ্রব্যের অলংকারের আধিক্য এবং স্বল্পমূল্য হওয়ায় অপরদিকে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা অনেক কমে গেছে।

যার ফলে এ সকল পেশার কারিগররা দারিদ্রের কষাঘাতে জরজরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের মূল্যায়ন যথাযথ ভাবে হচ্ছেনা। অস্তিত্ব রক্ষার্থে নতুন পথ খুঁজলেও স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা সবাই ব্যবসার ধরনের ডিজিটাল পরিবর্তন আনতে পারছেন না। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর মূলধন ও ছোট খুপরি সাদৃশ্য ঘরের সমস্যার কারনে প্রয়োজনীয় সংস্করণ ও ডেকোরেশন করা যাচ্ছে না।

এরকম নানাবিধ সমস্যার কারনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শিল্প স্বর্ণের গহনা ও এর কারিগররা। জীবন জীবিকার তাগিদে বংশ পরম্পরায় এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকেই।

এই ব্যবসা সম্পর্কিত সকলেরই দাবী যদি সরকারী বা বেসরকারী ভাবে সহজ শর্তে ঋন বা পৃষ্ঠপোষকতা করা যায় তাহলে এক সময়ের রাজকীয় ও এতিহ্যবাহী এ শিল্প টিকে থাকবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে