jute

বিডি নীয়ালা নিউজ(১৩ই মার্চ১৬)-কৃষি প্রতিবেদনঃ পাট বাংলাদেশে স্বর্ণ সূত্র নামে পরিচিত৷ এই পাট নিয়ে এক সময় রচিত হত বাংলাদেশের সকল অর্থনীতির ভিত৷ ‘বোনকে দেব পাটের শাড়ি মাকে দেব রঙ্গিণ হাঁড়ি’ খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীনের কবিতার এই লাইনে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে হয়তো পাটের শাড়ি এখন কেউ দেখেনি৷ তবে কবিতার বাণী শীঘ্রই সত্যি হতে চলেছে বলে বিজ্ঞানীরা জানান৷ দেশীয় বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন পাটের আঁশের গুণগত মান বাড়িয়ে পোশাক থেকে শুরু করে ঘরের আসবাবপত্র পর্যন্ত তৈরির উপযোগী করে তোলার৷ উদ্দেশ্য পাটের সর্বোচ্চ ব্যবহার৷ এটি করতে পারলে দেশে পাটের উত্‍পাদন যত বেশিই হোক তার চাহিদা থাকবে৷ আর দেশীয় পাটের জন্ম রহস্য আবিষ্কারের মাধ্যমে এ কাজটির প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন করা হয়েছে৷ এখন শুধু বাকি এটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া৷ আগামী তিন বছরের মধ্যে এটিও শেষ হবে৷ তবে সামগ্রিক প্রক্রিয়া শেষ করতে আরও দুবছর বাড়িয়ে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷
তারা জানিয়েছেন, মূলত দেশীয় পাটের যে গুণাগুণ তাতে একটা সময় এটিকে সাধারণ সুতার মতো ব্যবহার করা সম্ভব৷ আর দেশীয় পাটের উন্নত সংস্করণ হবে ধবধবে সাদা৷ যা কোন প্রক্রিয়া ছাড়া সরাসরি পণ্য তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে৷ আর এসব পণ্য প্লাস্টিক বা সুতার চেয়ে আরামদায়ক হবে বলেও তারা মনে করছেন৷
গত ১৯ আগষ্ট ২০১৩ দেশীয় পাটের জন্মরহস্য (টোটাল জিনোম) আবিষ্কার ও ঘোষণা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়৷ দেশে পাট বিজ্ঞানীদের করা সংবাদ সম্মেলনে তারা জানিয়েছেন, এই জিনোম আবিষ্কারের ফলে আইনত পাটের প্যাটেন্ট রাইট এখন বাংলাদেশের হাতে৷ গবেষণা প্রধান মাকসুদুল আলম বলেন, এখন বিশ্বের যে কেউ পাট নিয়ে গবেষণা করুক আমাদের উপেক্ষা করতে পারবে না৷
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. কামাল উদ্দিন, পরিচালক কৃষি মোহাম্মদ হোসেন, পরিচালক (কারিগরি গবেষণা) আসাদুজ্জামান, প্রিন্সিপাল সাইন্টিফিক অফিসার ড. সামিউল, চিফ সাইন্টিফিক অফিসার মঞ্জুরুল আলম প্রমুখ৷
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখন থেকে জিনোম সিকোয়েন্সের সহায়তায় মার্কার অ্যাসিস্টেড সিলেক্টিভ ব্রিডিং (এমএএস) বা জেনেটিক মার্কার সহায়তায় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজনন’ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে৷ ফলে পাটের গুণগত মান আরও উন্নত করা সম্ভব হবে৷ যা আমাদের দেশে পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াবে৷ এছাড়া দেশীয় পাটের চাষাবাদ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উত্‍পাদন খরচও কমবে৷ যা পাটের সোনালি সুদিন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে৷
তবে জিন নকশা আবিষ্কারের সুবাদে ভালো জাতের পাটের উদ্ভাবন হলেই কি সেই হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার হয়ে যাবে কিনা এবং জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার না করেই ভারত কি করে পাটের সুদিন এনেছে এবং ধরে রেখেছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা বলেন, শুধু পাটের আবাদ বা উত্‍পাদন বাড়ালেই পাটের সুদিন ফিরে আসবে না, এর জন্য দরকার পাটের বহুমুখী ব্যবহার৷ তারা বলেন, এক সময় বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ ফরেন কারেন্সি পাটের মাধ্যমে আসতো৷ এখন তা হয় না৷ তারা বলেন, পণ্যের প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ এটি যদি মানা হয় তাহলে দেশে এখনও ১৫ লাখ বেল বেশি পাটের দরকার হবে৷ এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারও ধরে রাখা সম্ভব হবে৷ দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে আমরা অতিরিক্ত পাট বিদেশে রপ্তানি করতে পারব বলেও জানান তারা৷
প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে এ সময় প্রশ্ন করা হলে গোপনীয়তার জন্য এর পরিমাণ জানানো যাবে না বলে বিজ্ঞানীরা জানান৷ তবে উন্নত দেশে এসব গবেষণায় যে ব্যয় করে তার দুই শতাংশও এখানে ব্যয় করা হয়নি বলে দাবি করেন তারা৷ অন্যদিকে গবেষণা কাজে বিজ্ঞানীদের ভূমিকা তুলে ধরে এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, এখনকার সময় বিজ্ঞানের সময়৷ তাই বিজ্ঞানের নলেজ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়৷ তবে আমাদের দেশে শুধু সরকারি অর্থায়নে গবেষণা পরিচালনা করা কঠিন৷ বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে৷
গবেষণার প্রকল্প 
চারটি স্তরে পাটের গবেষণা কাজ পরিচালনা করেন বিজ্ঞানীরা৷ এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে পাটের তথ্য ও নমুনা সংগ্রহ করে তা যান্ত্রিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়৷ তার পর এটিকে আলন্ট্রাসেন্টিফিউজ মেশিনের মাধ্যমে ডিএনএ গ্রেডিং করা হয়৷ এই মেশিনটি মিনিটে এক লক্ষবার ঘুরে পাটের প্রতিটি ডিএনএ তথ্য বের করে আনে এবং কয়েকটি গ্রেড বা স্তরে সাজিয়ে দেয়৷ এর জন্য তিন থেকে চার দিন সময় লাগে৷ তৃতীয় প্রক্রিয়ায় এই সব তথ্য নিয়ে ডিএনএ সিকোয়েন্স করা হয়৷ এই সিকোয়েন্সের মাধ্যমে পাটের কোয়ালিটি, কোয়ান্টিটি ইত্যাদি জানা যায়৷ ইনোভেটিভ মেশিনের মাধ্যমে তথ্যপ্রক্রিয়া শেষ হলে এই তথ্যের সংখ্যা কয়েক গিগাবাইটে দাঁড়ায়৷ একই সঙ্গে পাট আঁশের চিত্র ফুটে ওঠে কম্পিউটারের মনিটরে৷ যা থেকে পাট আঁশের ঘনত্ব, রং ও গুণাগুণ জানা যায়৷
প্রকল্প সাফল্য 
গত ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রজেক্টটির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত তিন ধরনের বড় সাফল্য এনেছেন বিজ্ঞানীরা৷ এর মাধ্যমে তোষা পাটের জিনোম রহস্য আবিষ্কার করে বাংলাদেশ যে আসলেই পাটের জনক তা আবারও প্রমাণ করেছে তারা৷ ২০১০ সালের জুন মাসে এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়৷ এর পর এক বছরের মাথায় দেশীয় পাটের জিনোম তথ্য আবিষ্কার করেন তারা৷ ওই জিনোম রহস্যের মাধ্যমে দেশীয় পাটকে উন্নত করে ধবধবে সাদা এক ধরনের পাট আবিষ্কার করেন৷ পরে কৃষক পর্যায়ে পরীক্ষামূলক উত্‍পাদনে পাঠায় সেগুলো৷ কিন্তু তাতে ‘লিগনিন নামক জৈব রাসায়নিক পদার্থ বেশি থাকায় পাটের আঁশ মোটা হয়৷ যা দিয়ে দড়ি ও চট তৈরি ছাড়া অন্য কিছু করা যায় না৷ তাই আবার তা গবেষণাগারে ফিরিয়ে এনে লিগনিন নামক ছত্রাকের জিন নকশাসহ দেশীয় পাটের জিনোম সিকোয়েন্স বা জিন নকশা আবিষ্কার করা হয়৷ যা গত ১৮ আগষ্ট ২০১৩ প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেন৷ এর ফলে এখন থেকে দেশি পাটের আঁশ চিকন ও মসৃণ হবে৷ একই সঙ্গে এগুলো ধবধবে সাদা রং থাকবে৷ যা কোন প্রক্রিয়া ছাড়াই পণ্য তৈরি করা যাবে৷ এছাড়া আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এটি সুতার মতো মোলায়েম ও আরামদায়ক করার কাজও শেষ হবে বলে জানান পরিচালক (কারিগরি) আসাদুজ্জামান৷ যা সুতার সঙ্গে মিশিয়ে সহজে কাপড় তৈরি করা যাবে৷
আবিষ্কৃত ধবধবে পাট 
সাধারণত দেশে বর্তমানে তোষা ও দেশি এই দুই নামের পাট চাষ হচ্ছে৷ এর মধ্যে তোষার উত্‍পাদন বেশি৷ বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত লিগনিন নামক জৈব রাসায়নিক পদার্থমুক্ত দেশি পাট দেখতে ধবধবে সাদা বলে বাংলায় এর নাম দেয়া হয়েছে ‘দেশি ধবধবে সাদা পাট’৷ উজ্জ্বল সাদা রঙের এই পাটের আঁশগুলো তোষা বা দেশি সাধারণ মানের পাটের চেয়ে অনেকটাই চিকন৷ একই সঙ্গে মসৃণও৷ তবে পাটগাছে আকার ভেদে আঁশ হয়ে থাকে৷ বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটগাছের আঁশের পরিমাণ বাড়াতে৷ যদি এটি করা যায় তাহলে অল্প জমিতেই চাহিদা মতো বেশি পাট উত্‍পাদন করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা৷
পরিশেষে, পাটের জন্ম রহস্য আবিস্কারকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের হারানো গৌরব আবার ফিরে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন মহলের ৷ দেশ একদিকে যেমন অর্থনীতিতে লাভবান হবে, অন্যদিকে পলিথিনের পরিবর্তে পাটের বহুমুখী ব্যবহারে পরিবেশ হবে নির্মল৷

লেখকঃ কৃষিবিদ মোঃ নূরুল হুদা আল মামুন ।

সূত্রঃ কৃষিবার্তা

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে