হামিদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। জমি-জমা বিক্রি করে ও বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে ধারদেনা করে ইউরোপের একটি দেশে যেতে চেয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। পাসপোর্ট, ভিসা সম্পূর্ণ করার পর একটি ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বিমানের টিকিট কাটেন তিনি। স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে ধারদেনা পরিশোধের পর পরিবারকে সচ্ছল করার।  কিন্তু তা আর হলো না। বিমানবন্দরে গিয়ে তার সেই স্বপ্ন নিমিষেই গুড়ে বালি হয়ে যায়।

বিমানবন্দরে গিয়ে হামিদুল জানতে পারেন প্রায় লাখ টাকা মূল্যের তার বিমানের টিকিটটি ভুয়া। তার টিকিটের টাকা রিফান্ড করে নেওয়া হয়েছে।

বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানের আগাম টিকিট কেটে দুদিন পর রিফান্ড করে উধাও হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি প্রতারক ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসব এজেন্সি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জানায়, যে কোনো এয়ারলাইন্সের নিশ্চিত টিকিট পাইয়ে দেবে। যাত্রীরা তাদের নির্ধারিত তারিখে গন্তব্য নিশ্চিত করার জন্য দ্বারস্থ হন এসব এজেন্সির। কখনো যাত্রীরা সরাসরি আবার কখনো সাব এজেন্টের মাধ্যমে টিকিট ক্রয় করেন।

কিন্তু বিপত্তি ঘটে যাত্রার তারিখে। যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন তাদের টিকিটটি ভুয়া। টিকিটের টাকা আগেই রিফান্ড করে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে এসব এজেন্সি ওই যাত্রীদের আবার নতুন করে টিকিট দেয়। কিন্তু সেই টিকিটেও যাত্রীরা গন্তব্য যেতে পারেন না। বেশকিছু যাত্রী ও এজেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এরপর টিকিট প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি এজেন্সিকে শনাক্ত করেছে ডিবি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমানের টিকিট নিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান যেভাবে প্রতারণা শুরু করছে আসন্ন হজ মৌসুমে এ প্রতারণা আরও ভয়ংকর রূপ নেবে। এসব প্রতিষ্ঠান দুবাই এয়ারওয়েজ, এয়ার আরবিয়া, এমিরেটস এয়ার, কাতার এয়ারওয়েজ, এয়ার ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকিট পাসপোর্ট দিয়ে বৈধভাবে বুকিং করে যাত্রীদের প্রিন্ট কপি দিয়ে প্রতারণা করছে। তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন খোদ বিমান বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সি বাংলাদেশের তথ্যমতে, সারাদেশে বৈধ ট্র্যাভেল এজেন্সি রয়েছে সাড়ে তিন হাজার। এর বাইরে ১৮ হাজার অবৈধ এজেন্সি আছে। এসব এজেন্সির শুধু সাইনবোর্ড ও ভিজিটিং কার্ড আছে। কিন্তু কোনো লাইসেন্স নেই। তাদের নেই কোনো নির্দিষ্ট বসার স্থান বা অফিস। দুদিন পর পর তারা অফিস পরিবর্তন করে। এক স্থানে অফিস নিয়ে কিছু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আবার নতুন স্থানে গিয়ে অফিস খুলে। তারা টিকিটের টাকা নিয়ে নিজেরাই ফটোশপে বসে ভুয়া টিকিট তৈরি করে যাত্রীদের ই-মেলে পাঠায়।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রতারক এজেন্সিগুলো নামে-বেনামে কাজ করছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তারা অস্থায়ী অফিস খুলে বসেছে। যে কোনো দেশের ভ্রমণ ও ওয়ার্কিং ভিসা প্রসেস এবং টিকিট কেটে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে তারা প্রচারণা চালায়। ব্যক্তিগত অথবা সাব এজেন্টের কাছে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলোর যাত্রীদের কাছে টিকিট আগাম বিক্রি করে। টিকিটের মূল্যের সমপরিমাণ টাকা দেওয়ার পরে তারা যাত্রীদের ই-টিকিটের একটি কপি দেয় ই-মেইলে। যেখানে যাত্রীর নাম, জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট নম্বর, ট্রানজিটসহ সবকিছু উল্লেখ থাকে। যাত্রী তখন ই-টিকিট নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে।

ভ্রমণের নির্ধারিত তারিখে যাত্রীরা পরিবার ও স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্যাগ, লাগেজসহ বিমানবন্দরে হাজির হন। কিন্তু বোডিং পাসে গিয়ে আটকে যান তারা। সংশ্লিষ্ট বিমানের কর্মকর্তারা টিকিট চেক করে জানান, টিকিটের বুকিং ঠিক ছিল, কিন্তু বুকিং দেওয়ার পরে টিকিটের টাকা রিফান্ড করে নেওয়া হয়েছে। ওই টিকিটের আর কোনো বৈধতা নেই।

এই কথা শোনার পর যাত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এভাবেই প্রতিনিয়ত আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। অনেকেই মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন। উপায় না পেয়ে যাত্রীরা ওই এজেন্সি বা মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন এজেন্সি বিভিন্নভাবে ওই যাত্রীকে বুঝ দিয়ে ফের টিকিট কেটে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। এজন্য আবার ৫০ থেকে ১৫০ ডলার পর্যন্ত ফ্রি নেন তারা। টাকা নেওয়ার পরও দ্বিতীয়বার যে টিকিট দেওয়া হয় যাত্রীরা বিমানবন্দরে যাওয়ার পর সেটিও ভুয়া টিকিট বলে প্রমাণিত হয়। তখন যাত্রীদের চাপে পড়ে একটা পর্যায়ে এজেন্সির লোকেরা মোবাইল ও অফিস বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যায়।

এদিকে, একটি এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড সার্ভিস সুপারভাইজার মো. সাইদুর রহমান। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে একটি অভিযোগে করেছেন। একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও পরিচয়দানকারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার কয়েক মাস আগে পরিচয় হয়। ওই ব্যক্তি দাবি করেন তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিকিট ক্রয় করে যাত্রী পাঠান।

গত ২৬ মার্চ সাইদুর রহমান ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, পাঁচজন যাত্রীর জন্য মাস্কট, রিয়াদ, টরেন্টোর টিকিট কেটে দিতে হবে। আশ্বাস পেয়ে তিনি ওইদিনই সাইদুরের রাজধানীর ভাটারা অফিসে গিয়ে মাস্কটের যাত্রী মুসাহিদের টিকিট বাবদ তার কাছে ৭৬ হাজার টাকা দেন। পরে ওই ব্যক্তি মুসাহিদের নামে বুকিং করা একটি টিকিটের কপি পাঠায়। পরের দিন ২৭ মার্চ বিকেলে রিয়াদগামী যাত্রী মো. মহসীনের টিকিটের জন্য ৬৭ হাজার এবং টরেন্টোর জন্য মো. যুবায়ের হোসেন ও তার পরিবারের দুই সদস্যের জন্য ৩ লাখ ৭০ হাজারসহ মোট ৫ লাখ ১০ টাকা দেন সাইদুর। এর বিপরীতে ওই ব্যক্তি মাস্কট ও রিয়াদের যাত্রীদের দুটি টিকিট সরবরাহ করেন। কিন্তু ২৮ মার্চ রিয়াদের যাত্রী মহসীন বিমানবন্দরে এসে জানতে পারেন তার টিকিটটি ভুয়া। টিকিটের টাকা রিফান্ড করে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি মহসীন সাইদুরকে জানালে তিনি ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে তিনি আরেকটি টিকিট ইস্যু করে দিলেও সেই টিকিট দিয়ে মহসীন রিয়াদ যেতে পারেননি। তখন সাইদুর এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ দিয়ে টিকিট যাচাই করে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। এছাড়া টরেন্টোর তিনটি টিকিটও ওই ব্যক্তি তাকে সরবরাহ করেননি। উল্টো অফিস ও মোবাইল ফোন বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যান। তখন কোনোভাবে ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ৩১ মার্চ সাইদুর এজেন্সির ভাটারার অফিসে গিয়ে জানতে পারেন আরও অনেকের সঙ্গে ওই ব্যক্তি প্রতারণা করেছেন।

অভিযোগে সাইদুর আরও উল্লেখ করেন, ওইদিনই আরেক যাত্রীর টিকিটের টাকা নেওয়ার জন্য ওই ব্যক্তি তেজগাঁও লিংক রোড শান্তা টাওয়ারের সামনে অবস্থান করছে বলে জানতে পারেন। যার কাছ থেকে টাকা নেবেন তাকে অনুসরণ করে তিনি ওই ব্যক্তির কাছে পৌঁছান। সাইদুরকে দেখে ওই ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে যান। তখন পুলিশের সহায়তায় ওই ব্যক্তি সাইদুরকে নগদ ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, একটি অঙ্গীকারনামা ও বাকি টাকার জামানত স্বরূপ ৫ লাখ ১০ হাজার টাকার একটি চেক দেন। পরের দিন ওই চেকটি ব্যাংকে জমা দিলে ডিজঅনার হয়। ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সাইদুরকে নানারকম ভয়ভীতি দিয়ে তার চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দেন।

টিকিট প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, বিদেশগামী যাত্রীদের টিকিট নিয়ে নতুন এক প্রতারণা শুরু হয়েছে। আগাম টিকিট কেটে দিয়ে আবার টাকা রিফান্ড করছে কিছু এজেন্সি। যেসব এজেন্সি এরকম করছে তাদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চলছে। এই এজেন্সিগুলোর সঙ্গে যারা কাজ করে সেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের দুর্দশা লাঘব করার জন্য কিছু প্রো-অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) কাজ করতে পারে। প্রতারক এজেন্সিগুলোর সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

Jag/N

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে