…………………………মাহফুজার রহমান মণ্ডল

কার্তিক-অগ্রহায়ণের পর পৌষ পার্বণে পিঠা এর পরই মাঘ, ওবাপরে এবার কান্দিবে বাঘ। কথিত আছে “মাঘের জারে বাঘ কান্দে” প্রবাদটি সেকালের মনে হয় কিন্তু প্রবাদটি কি সেকালেরই রয়ে যাবে? এইতো কয়েক দিন আগে এক দাদুর দেখা বয়স প্রায় ৮০ বছর, কি যে ফোকলা দাঁতের হাসি হাসল, সালামটা নিমিষেই সেরে নিয়ে জড়িয়ে ধরল। কত দিন পর দেখা ভালো আছ দাদু ভাই। হু বলতেই আবার সেই ফোকলা দাঁতের হাসি, হাসি আর থামে না। সেই সুযোগে বললাম দাদু শীতটা এবার কেমন কাটবে? হাসি থেমে গেল এবার টকবকে রাগ করে ‘আগের শীত কি এখন আর আছে, মাসখানিক যাইতে দে মোর মাথার উপর এখন ফ্যান ঘুরবে”।

যাইহোক দাদু শহরের মানুষ গ্রামে ওনার যোগাযোগ কম শহরের মানুষ হিসাবে ওনার এ ধরনের ধারনাটা হওয়া স্বাভাবিক। এদিকে শুধু শীতকাল নয়, অন্যান্য ঋতু সম্পর্কেও ওনার ধারনা আছে। তাই আজ শুধু ওনার নয় সারা বাংলার মানুষ ঋতুর এ পরিবর্তন অনুধাবন করছে। এটার কারন হিসেবে জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে। আর জলবায়ুর পরিবর্তন আজ বিশ্ববাসী নাড়া দিয়েছে যেখানে বাংলাদেশের মতো গরীব দেশগুলো হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচার এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা ও বিশ্বের দেশগুলোর করণীয় নিয়ে ব্রাজিলের রিওতে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলন হয় ১৯৯২ সালে। ‘আর্থ সামিট’ নামে এটি পরিচিত। বিশ্বনেতাদের মধ্যে এর আগেও এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে এবং দেশগুলোর মানুষের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে, সে ব্যাপারে দেশগুলো একমত হয়। সেখানে একটি জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন গৃহীত হয়, এটি ইউএনএফসিসিসি (ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) নামে পরিচিত এবং তাতে বলা হয়, পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতগুলো আমরা দেখছি, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, ভবিষ্যতে এগুলো আরো বাড়তে পারে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা কমানোর জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে হবে। এ সম্মেলনের ফলোআপ হিসেবে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম ১০-১২ তারিখ পর্যন্ত এই বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ বা কপ (ঈঙচ) নামে অভিহিত। ২০ বছর ধরে কখনো অফ্রিকা, কখনো ইউরোপ, কখনো উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে হয়ে আসছে। প্রথমদিকে শুধু আলোচনা করা হতো, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কিভাবে কমানো হবে। তারপর আলোচনায় এলো, যে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে, তাতে অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের জন্য কী করতে হবে? প্রথমে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ছিল না। পরে এ বিষয়টির গুরুত্ব মাথায় আসে। বাংলাদেশের জন্য এটিই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়। উন্নত দেশগুলোতে দুর্যোগ দেখা দিলে তা মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট আয়োজন করা আছে বা অর্থ আছে কিন্তু গরীব দেশগুলোর কি আছে? নেই তাদের অর্থ নেই দুর্যোগ মোকাবেলার অস্ত্র।

গরীব দেশগুলোর দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য তহবিল গঠিত হয় কিন্তু দুঃখের বিষয় সঠিক সময়ে এর অর্থ মেলে না তাই শনিবার(০৮/১০/১৬)ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের সভাপতিত্বে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মুহিত বলেন, “তহবিল গঠন হয়, কিন্তু অর্থ মেলেনা। এটা দুঃখজনক।” এ সুরাহা করতে উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় গত ছয় বছরে বাংলাদেশ ৩৪৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। কিন্তু জলবায়ু তহবিল থেকে পেয়েছে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার।“আরও ১০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হবে, হবে বলেও দেওয়া হচ্ছে না।”

বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে বৈঠকে আমি করুণ এই চিত্র তুলে ধরেছি। বলেছি, শুধু অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি বা তহবিল গঠন করলেই হবে না, সেই তহবিলের অর্থ যাতে ক্ষতির শিকার দেশগুলো পায় সেটা নিশ্চত করতে হবে।” জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা অন্য দেশের প্রতিনিধিরাও বৈঠকে একই দাবি জানিয়েছেন বলে জানান মুহিত।

তিনি বলেন, “উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের ফলে ছোট দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে গঠিত তহবিলের অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।”(০৯/১০/১৬)bdnews24.com

 জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি, এর অনেকগুলো কারণ আছে। বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটি খুব বেশি উঁচুতে নয়। দেশের অবস্থান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা-এই তিনটি বড় নদী অববাহিকার সর্বনিম্ন। বর্ষাকালে পানি নিচের দিকে আসে কিন্তু দ্রুত পানি নেমে যায় না বলে বন্যা হয় আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির সমস্যা দেখা দেয়। যদিও পানি শুষ্ক মৌসুমে থাকত এর নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই, নিয়ন্ত্রণ ওপরে। আরেকটি কারণ হলো, আমাদের অনেক লম্বা-৭০০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ তো এখন উঁচু হচ্ছে, ফলে লবণাক্ত পানি জোয়ারের সঙ্গে দেশের অনেক ভেতরে ঢুকছে। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় এক হাজার ১০০ মানুষের বসবাস। এসব কারণে এখানে একটি ঝড়, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। আমাদের উপকূলীয় এলাকায় মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাস করে। ফলে তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন দুর্যোগে আক্রান্ত অন্যান্য অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ। এই সব সমস্যা যখন-তখন দেখা দিচ্ছে ফলে সোনার বাংলার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ঋতুগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে ফেলছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমদের সরকার বসে নেই তা আমাদের অর্থ মন্ত্রী তহবিল নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট সামনে বলেছেন। এবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন- টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহের সফল বাস্তবায়নে জলবায়ুতাড়িত অভিবাসী সমস্যা সমাধানে বৈশ্বিক উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান। তিনি বলেন, জলবায়ুতাড়িত অভিবাসীর চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে আমরা কখনোই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে সক্ষম হবো না। তিনি মঙ্গলবার (১৫/১১/২০১৬) রাতে এখানে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২২) উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ কথা বলেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব সুসংহত করার লক্ষ্যে সবাইকে একজোট হওয়ার আহ্বান জানান। এ ছাড়া তিনি সেখানে কথা বলে ক্ষান্ত হননি অনেক কাজও করেছেন যেমন, প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম সারির দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুতে আমাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে ব্যর্থ হলে কোটি কোটি মানুষ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, আগামী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে নিরাপদ ও সুন্দর করতে আমাদের অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত হতে হবে।
তিনি আরও বলেন বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল থেকে ৪শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে সর্বপ্রথম ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট’ গঠন করেছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো জলবায়ু সম্পৃক্ত অধিক ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাফল্য অর্জন করেছে।
তিনি পূর্বসতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণসহ বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উল্লেখ করে বলেন, এসব পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে দুর্যোগকালে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অনেক হ্রাস পাবে।(১৬/১১/১৬) বিডি নীয়ালা নিউজ

আমাদের দেশের সরকার যেভাবে সচেতনতার সাথে কাজ করছেন আশাকরা যায় আমরা দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হব। তবে যাদের কারণে এই জলবায়ুর পরিবর্তন তাদেরকে ছাড়া যাবে না, এখানেও আমাদের সরকার তৎপর রয়েছেন তা উপরোক্ত আলোচনায় জানা গেছে।

এবার তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করা যাবে যদি সকারের পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হয়। ইতিমধ্যে সকারের অনেক পদক্ষপ বাস্তবায়ন হয়েছে সাথে এনজিওগুলোর ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ঋতুর রুপের কি হবে? ঋতুগুলোর রূপ যে হ্রাস পাচ্ছে এগুলো ফিরে আনার ব্যাপারে পদক্ষেপ কি? কে দিবে এর সমাধান? এটাই এখন বিশ্ববাসীর কাছে প্রার্থনা। তাইতো আমার “বিদ্রোহ তোমার জন্য” কবিতা থেকে নেওয়া কয়েকটা লাইন –

“তুমি কি ঘ্রাণ নিতে পার না?

পরে থাকা লাশের গন্ধ, পরিবেশ দূষণের অস্ত্র,

যারা বেঁচে আছে সব কিছু সহ্য করে নিরব নিরন্তে।

তুমি কি সাধ গ্রহণ করতে পার না?

বিভিন্ন ঋতুর বিভিন্ন খেলায় রঙবেরঙের মাঠে

আজ সব কিছু পরিবর্তন হচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণে

যদি তুমি বুঝতে পার, চিৎকার করে বল, বুঝেছি !“

 

মাহফুজার রহমান মণ্ডল

সম্পাদক- 

বিডি নীয়ালা নিউজ

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে