11-4

বিডি নীয়ালা নিউজ(২৯জানুয়ারি১৬)- কৃষি প্রতিবেদনঃ

‘আমার গাছে পোকা ধরছে।’

‘কী পোকা?’

‘এইডা তো কইবার পারুম না।’

‘আচ্ছা অসুবিধা নাই। দেখেন তো এই পোকাটা কি না?’

‘আরে এইডাই তো!’

‘ঠিক আছে, এই ওষুধটা কিনে গাছে দিয়েন। ভালো হয়ে যাবে।’

সম্প্রতি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার দুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও একজন কৃষকের কথোপকথন এটি। রোগ না জানলে যেমন ওষুধ দেওয়া যায় না, তেমনি পোকা-মাকড় সর্ম্পকে না জানলে এর প্রতিকারও সম্ভব নয়। কিন্তু কৃষকতো আর পোকা নিয়ে কৃষি অফিস আসে না। আর পোকার নামও কৃষক জানে না। তাই কৃষককে সঠিক সেবা দিতে ক্ষতিকর ও উপকারী দুই ধরণেরই শতাধিক জাতের পোকা-মাকড় নিয়ে এক সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার দুল্লা ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা।

কৃষক তার কাছে পরামর্শের জন্য এলে তিনি সংগ্রহশালার পোকাগুলো দেখিয়ে কৃষকের ফসল বা গাছের পোকা সর্ম্পকে নিশ্চিত হন। একই সঙ্গে রোগাক্রান্ত গাছ, পাতা ও ফলও তিনি সংগ্রহে রেখেছেন। এগুলোও কৃষককে দেখিয়ে নিশ্চিত হন কৃষকের কি ক্ষতি হচ্ছে। তার পর কৃষকদের দেন পরামর্শ কিংবা ব্যবস্থাপত্র। পুরো আয়োজনটিকে ‘পেষ্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টার’ নাম দিয়েছেন সেলিম রেজা। ময়মনসিংহতো বটেই দেশের অন্য কোথাও একেবারে নিজ উদ্যোগে এমন ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে কৃষককে সেবা দেওয়ার নজির নেই। সঠিক, সময়োপযোগী এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষকদের সেবা দিয়ে এলাকায় ইতিমধ্যেই ‘কৃষক বন্ধ’ু উপাধি পেয়েছেন এই কৃষি কর্মকর্তা। রাষ্ট্রীয়ভাবেও পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। জৈব কৃষিতে অবদান রাখায় তিনি ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু পুরষ্কার পান। পেয়েছেন আরও কিছু জাতীয় ও স্থানীয় পুরষ্কার।

সেলিম রেজা ১৯৮৯ সালে কৃষিতে ডিপ্লোমা নেওয়ার পর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে কৃষি বিভাগে যোগ দেন। প্রথম পোস্টিং ছিল সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। সেখানে গাছের কলম পদ্ধতি শিখিয়ে এলাকায় আলোড়ন তোলেন। এরপর ধাপে ধাপে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকুরী করে এখন তিনি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় দুল্লা ইউনিয়নে আছেন প্রায় সাত বছর ধরে। সেলিম রেজা কৃষি, কৃষকের সমস্যা, গাছ ও ফসলের রোগ বালাই, জৈব পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন চাকুরী জীবনের শুরু থেকেই। কাজ করতে করতে এক সময় তার মনে হলো কৃষককে পরামর্শ দিতে গেলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সেলিম রেজা এ ব্যাপারে বলেন, কৃষকতো আর জানে না পোকার নাম কি। কোন পোকা উপকারী কিংবা ক্ষতিকর তাও জানে না। কৃষক কীটনাশকের দোকান থেকে অনুমানে ঔষধ কিনে নিয়ে ব্যাপকভাবে এসব ব্যবহার করে। এতে কৃষক, ফসল, জমি, পরিবেশ সব কিছুরই ক্ষতি হয়। এ চিন্তা থেকেই আমি পোকা-মাকড় নিয়ে এবং রোগাক্রান্ত গাছ নিয়ে একটি সংগ্রহশালার কথা ভাবি। এরপর অনেক পরিশ্রম করে, এসব পোকা সংগ্রহ করতে থাকি।

সেলিম রেজা বলেন, ২০০৩ সালে তিনি প্রথম মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি মেলায় শস্য ক্লিনিক ও পোকার চিড়িয়াখানা নামে একটি স্টল প্রদর্শন করেন। ওই সময় সেটি ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে। এরপর বিভিন্ন মেলাসহ এই সেন্টারটি প্রায় ১৫ হাজার দশনার্থী পরিদর্শন করেছেন। তিন শতাধিক ব্যক্তি এ সেন্টারটি সর্ম্পকে মন্তব্য লিখেছেন। গত চার মাসে দুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে স্থাপিত তার সেন্টারে প্রায় ১৫০ কৃষক এসেছেন। এসেছেন ২৭ জন বিভিন্ন এলাকার কৃষি কর্মকর্তা। এছাড়া সময়ে সময়ে এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষি কর্মকর্তাদের শিক্ষানবীশ দলও আসেন।

সেলিম রেজার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা এ সেন্টারে কমপক্ষে ১০০ জাতের পোকা আছে। এ গুলোর মধ্যে উপকারী পোকা যেমন আছে, তেমনি আছে ক্ষতিকর পোকাও। ক্ষতিকর পোকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ধানের মাজরা পোকা, গান্ধী পোকা, বাদামী গাছ ফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ সুর লেদা পোকা, পামরী পোকা, ১২ ধরনের প্রজাপতি ইত্যাদি। উপকারী পোকা হিসেবে আছে লেডি বার্ড বিটল, ক্যারাবিডল বিটল, ড্যামসেল ফ্রাই, ড্রাগন ফাই, মাকড়সা ইত্যাদি। রোগে আক্রান্ত গাছ ও ফলের প্রায় ২০০ ধরনের নমুনা রয়েছে এখানে। এ গুলোর মাঝে হলো পচে যাওয়া কাঁঠাল, আমের বিকৃত মুকুল, লেবুর স্ক্যাব, পোকা আক্রান্ত কলা, আকাঁবাকা পেঁপে, বিকৃত নারিকেল, পোকায় আক্রান্ত বিভিন্ন গাছের পাতা ইত্যাদি।

পোকা সংরক্ষণের পদ্ধতি সর্ম্পকে সেলিম রেজা বলেন, পোকা গুলো প্রথম অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয়। এরপর প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক দুই পদ্ধতির ব্যবহার করেই পোকা গুলো সংরক্ষণ করা হয়। একই ভাবে গাছ, পাতা ও রোগাক্রান্ত ফল মূলও তিনি সংরক্ষণ করেন। এছাড়া এখানে সংগ্রহে আছে বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ৬৪ জাতের ধান। রয়েছে বিনা ও বারি উদ্ভাবিত ধানও। কৃষি সংক্রান্ত সব বই ও লিফলেট রয়েছে তার সেন্টারে। এ সেন্টারে মাটির স্বাস্থ্যও পরীক্ষা ও বীজ পরীক্ষা হয়। অনেক কৃষক বীজ নিয়ে এসে পরীক্ষা করিয়ে যান।

সেলিম রেজা বলেন, কোনো কৃষক আসলে প্রথমে তিনি কৃষককে ৭২টি প্রশ্ন করেন। এ প্রশ্ন গুলো লিখিত ভাবে তার কাছে আছে। প্রশ্ন গুলোর মধ্যে গতানুগতিক কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন চাষীর নাম কি, বাড়ি কই। এরপর জানতে চাওয়া হয় কোন ফসল, কি জাত, কতদিন ধরে সমস্যা। সমস্যা কোথায় পাতায়, কান্ডে, ফুলে না ফলে। গাছের/ফসলের কতভাগ আক্রান্ত ইত্যাদি। সব শেষে তিনি চাষীদের পরামর্শ কিংবা ব্যবস্থাপত্র দেন।

মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নার্গিস আক্তার বলেন, ‘সেলিম রেজা খুবই ভালো একজন কৃষি কর্মকর্তা। কৃষকদের উনি ভালো ভাবে গুছিয়ে বুঝাতে পারেন। ভাল কাজের জন্য এলাকার মানুষ ভালবাসে। বিষমুক্ত সবজি চাষে তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।’

দুল্লা ইউনিয়নের পূর্ব দুল্লা গ্রামের রিয়াজুল করিম ফরহাদ বলেন, ‘মানুষ চাকুরী করে। কিন্তু সেলিম রেজা শুধু চাকুরী করেন না। মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন। শুধু অফিস করেন না, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেন।’ গয়েশপুর গ্রামের শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যে কোনো কাজ করতে গেলে উনার পরামর্শ নেই। যখনই উনাকে ডাক দেই, তখনই উনি চলে আসেন।’

চাকুরী করতে করতে সেলিম রেজা উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএজিএড (ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচারাল এডেুকেশন) কোর্স করেছেন। মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে বর্তমানে তিনি আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে এমএস কোর্স করছেন।

নিজের কাজের জন্য সেলিম রেজা স্থানীয় ভাবে একাধিক পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি নেত্রকোনায় সেরা বিএস (ব্লক সুপাইভাইজার) মনোনীত হয়েছিলেন। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ প্রযুক্তিগত সম্প্রসারণে তিনি ২০০৮ ও ২০১২ সালে জাতীয় ভাবে পুরষ্কার পান। ২০১৩ সালে জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্পের আওতায় তিনি মালয়েশিয়া যান। তবে এর মাঝে তার সেরা অর্জনটি হলো ২০১৩ সালে জৈব কৃষিতে বঙ্গবন্ধু পুরষ্কার প্রাপ্তি।

লেখক: কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল ।

সূত্রঃ কৃষিবার্তা

 

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে