c792f3528c359b43884da22070520d38-57023b671bb22

বিডি নীয়ালা নিউজ(৪ই এপ্রিল১৬)-সাহিত্য ও সংষ্কৃতি প্রতিবেদনঃ ধূসর রংয়ের পুরনো জীর্ণশীর্ণ জামা, ময়লা প্যান্ট, ছেড়া জুতো। আর কাঁধে কবিয়াল ছেঁড়া ব্যাগ। মুখে মিষ্টি হাসি। বয়স আশির কাছাকাছি। দেখলেই বোঝা যায়, মনে কোন দুঃখ নেই, আছে শুধু সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন, কিছু সাধনা আর কবিতা লেখার নেশা। অভাবের তাড়নায় নিজের লেখা ইংরেজি ছড়া, কবিতা ও গান ফেরি করেন রাস্তায় রাস্তায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে কবিতা ফেরি করে চলছেন কবিতার এ ফেরিওয়ালা।

তাঁর নাম মহিউদ্দিন। তিনি কবিতা-গান লিখতে ছদ্মনাম ‘জন’ ব্যবহার করেন। থাকেন রাজধানীর আজিমপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, আজিমপুর-লালবাগের খুব কম ব্যক্তিই আছেন যারা তাকে চেনে না। তিনি কবিতা ভর্তি একটি কবিয়াল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পথচারীর হাতে কবিতা লেখা এক টুকরো কাগজ দিয়ে বলেন, ‘একটি কবিতা কিনবেন?’

আজিমপুর সরকারি কলোনিতে হঠাৎ দেখা হলো ভিন্নরকম এই ফেরিওয়ালার। কাছে যেতেই তিনি একটি কবিতা লেখা টুকরো কাগজ হাতে ধরিয়ে দিতে চাইলেন। কবিতা কিনবো এই আশ্বাস দিতেই চোখে-মুখে খুশির ছায়া দেখতে পেলাম।

কথা বলতে শুরু করলেন। নিজের জীবনের কিছু মূল্যবান স্মৃতি আওয়াতে থাকলেন। জানালেন, সারারাত ধরে তিনি কবিতা লেখেন। প্রতিদিন সকালে নতুন নতুন কবিতা নিয়ে বের হয়ে পড়েন রাস্তায় বিক্রির জন্য। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কবিতা ফেরি করে প্রতিদিন ২’শ থেকে ৩’শ টাকা আয় হয় তার। মাঝে মাঝে বেশি অথবা কমও হয়।

তিনি জানান, ১৯৬০ সালে বি. এ. পাশ করার পরে ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু শেষ না করেই ১৯৬৫ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করেন। মাস্টার্স শেষ করে ঢাকায় ফিরে আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল নামে একটি স্কুলে ১৯৬৭ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু মাত্র ১ বছরের মাথায় ১৯৮৬ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।

স্কুলের চাকরি ছেড়ে তিনি ‘মর্নিং নিউজ’ নামের একটি ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে পত্রিকা বন্ধের কয়েকমাস আগে তার চাকরি চলে যায়। তার বক্তব্য অনুযায়ী ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হত তিনটি দেশে। লন্ডনে, পাকিস্তানে আর বাংলাদেশে।

ef8906e742ea0ab8b7023f06c550e2ed-57023b6a3e7fd

তিনি বলেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখি আমি। মাঝে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম তাই লিখতে পারিনি। এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার কবিতা লিখেছি কিন্তু মাত্র কয়েক’শ কবিতা সংরক্ষণে আছে। বাকি সবই হারিয়ে গেছে, সংরক্ষণ করিনি কখনও।

সম্প্রতি তার লেখা একটি ছড়া ‘nothing is thing’। তিনি ছড়াটি দেখিয়ে বলেন, এই ছড়াটি লিখেছি কিন্তু অনেকেই এর অর্থ বোঝেনি। তার এসব কবিতা কেউ কেনে আবার অনেকেই কেনে না। যারা কেনে তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ থাকেন। প্রাণভরে দোয়া করতে থাকেন, আর বলেন ‘শিক্ষিত মানুষরাই এর মূল্য বোঝে।’

বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে তিনি একটি ইংরেজি গান লিখেছেন। সেই গান পুলিশদেরকে দেখাতেই পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন সদস্য সেটি গ্রহণ করে সুর করে গেয়েছেন বলে বেশ খুশি তিনি।

কথায় কথায় ইংরেজি বলেন তিনি। ইংরেজি বলার স্টাইলটি বৃটিশ ধাঁচের। ইংরেজি বাক্য গঠনে ‘ক্যাপিটাল লেটার’ ব্যবহারের ব্যাপারে তিনি নিজের একটি মতবাদ দিয়ে বসলেন। ইংরেজি লেখার ক্ষেত্রে তিনি ‘ক্যাপিটাল লেটার’ ব্যবহারের বিপক্ষে। কারণ হিসেবে বলেন, ‘ইংরেজি পড়তে বা বুঝতে ‘ক্যাপিটাল লেটার’ না লিখলেও তো সমস্যা হচ্ছে না। আমরা যদি ‘ক্যাপিটাল লেটার’ ছাড়া শব্দ লিখি তাহলে কি বুঝি না? পড়তে কি কোন সমস্যা হয়? তাছাড়া কত সময় বেঁচে যায়। আমি যত কবিতা লিখেছি একটিতেও ‘ক্যাপিটাল লেটার’ নেই। কিন্তু কোন সমস্যা হতে তো দেখি না।’

অন্যদিকে ইংরেজি বাক্যে তিনি ‘হি’(He) এবং ‘শি’(She) ব্যবহার করতে চান না। ‘He is my brother, ও She is my sister’। এই বাক্য দুটির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এই দুটি বাক্যেতেই যদি আমরা একই শব্দ ‘হি’(He) অথবা ‘শি’(She) ব্যবহার করি তাহলে কি কোন সমস্যা হবে ‘ভাই’ অথবা ‘বোন’ বুঝতে? বাক্যে ‘brother’ ও ‘sister’ শব্দ ব্যবহার করলেই তো বোঝা যাচ্ছে কোনটা ছেলে আর কোনটা মেয়ে।

এক পর্যায়ে তিনি জানালেন, সাংবাদিকতা বেশিদিন করতে পারেননি। যখনই ভাষার এমন ব্যবহার পরিবর্তন করতে চেয়েছেন তখনই তার চাকরি চলে গেছে। অভাবের তাড়না আর কবিতা লেখার সাধনাকে তিনি একই রেখায় রেখেছেন। চলছেন রাস্তায় রাস্তায়। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কবিতা বিক্রি করেন। কথাগুলি বলতে বলতে মাথাটা নিচু করে করুণ সুরে তিনি বলেন, ‘এখন সবাই আমাকে পাগল বলে।’

তার পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, তার স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। দুটি ছেলে আছে কিন্তু তারা কিছুই করে না। বাড়ি আছে ছয়তলা, ভাড়া বাবদ যা পায় তা দিয়ে ছেলেদের সংসার চালায়।

ছয়তলা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন কবিতা বিক্রি করে অর্থ আয় করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সন্তানদের কাছে হাত পাততে চাই না। তাই নিজের যে সামর্থ্য আছে সেটাই কাজে লাগাই।

এসব বলতে বলতেই কাঁধের ব্যাগে শতাধিক কবিতা দেখিয়ে একটি কবিতা কিনতে অনুরোধ করলেন। কবিতাটির মূল্য দিতেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার চেষ্টা শুরু করেন। জোর করে সালাম করা থেকে বিরত রাখলে তিনি বলেন, ‘আমার কোন কবিতা টাকার বিনিময়ে যিনি কিনেন তিনি মহান। তার ঋণ শোধ করার মতো না তাই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে মাফ চেয়ে নেই।

সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে