মারুফ সরকার, বিনোদন ডেস্কঃ দেশের বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ৬০’র দশক থেকে তিনি অভিনয় করছেন। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রবীর মিত্র ‘নায়ক’ হিসেবে কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এরপর ‘চরিত্রাভিনেতা’ হিসেবে কাজ করেও তিনি পেয়েছেন দর্শকপ্রিয়তা। চার শতাধিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের অভিনেতা প্রবীর মিত্র। তবে ‘ভালো নেই’ বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ষীয়ান এ অভিনেতা। শারীরিক অসুস্থতা ও একাকীত্ব সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর সেগুনবাগিচার বাসায় চার দেয়ালের মাঝে দিন কাটছে ৭৮ বছর বয়সী এই অভিনেতার। শারীরিক ও চলচ্চিত্রের সমসাময়িক অবস্থা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সাক্ষাতকার নিয়েছেন- মারুফ সরকার

কেমন আছেন?
ভালো নেই। দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। দিনরাত বাসায় থাকি। এ ঘর থেকে ও ঘরে যাই লাঠিতে ভর করে। অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। বাসাবন্দী বাইরে বের হতে পারি না। বড্ড খারাপ লাগে। চলাচল করতে খুবই কষ্ট হয়।

বাসায় বসে দিন কাটাতে কেমন লাগছে?
লাগালাগি নাই। বাধ্য হয়েই বাসায় থাকতে হচ্ছে। উপায় নেই। এ ভাবেই দিন কাঁটাতে হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ। এফডিসি যেতে খুব ইচ্ছে করে। যেতে পারি না হাটার সমস্যা। হাটলে পেইন হয়, কষ্ট হয়। এফডিসি আমার স্বপ্নের জায়গা। অনেক ভালবাসার জগত। এটাকে ভুলতে পারি না। যেতে খুব ইচ্ছে হয়। তবে যেতে পারি না দুঃখ হয়, আক্ষেপ হয়। ভালো হলে যাবো ইচ্ছে আছে।

অনেক দিন ধরেই অসুস্থ রয়েছেন। আপনার সহশিল্পীরা খোঁজ খবর নেয়?

যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। কে কার খবর রাখে? কেউর খবর রাখার সময় নেই। আমি কি কেউর খবর রাখতে পারি? কাকে দোষ দেব? নিচ্ছে না বলব না। কিছু মানুষ খোঁজ খবর নেয়। একজন থেকে আরেক জন এ রকম করে একে অপরে খোঁজ খবর নেয়।

অনেক অসুস্থ শিল্পীর পাশেই প্রধানমন্ত্রী থাকেন। আপনার অসুস্থতার ব্যাপারটি জানিয়েছেন?
না জানাই নাই। সে জানে কি-না তাও জানি না। আপনার জানালে জানাতে পারেন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিল্পবান্ধব। তার উদ্যোগ কে সাধুবাদ জানাই। শিল্পী সংস্কৃতি মানুষদের কষ্টটা ফিল করেন তিনি। অসহায় শিল্পীদের পাশে এসে বরাবরই সহযোগীতার হাত বাঁড়িয়ে আসছেন তিনি। এ জন্য আমি তার কাছে কৃতঘ্ন। নিজ অর্থ দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছে।পরমুখাপেক্ষী হয়ে আছি। হোক না সে আমার ছেলে বউ মা। আমি তো কিছুই করতে পারি না। পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকা কঠিন ব্যাপার। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি নিজ থেকে সহযোগীতার হাত বাড়ায় আমার আপওি নেই।

চলচ্চিত্রের মানুষদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান এফডিসি। মাঝে মধ্যে এফডিসিতে যেতে ইচ্ছে করে না?
খুব ইচ্ছে করে। তবে এফডিসি না-কি ভুতুরে বাড়ি হয়ে গেছে শুনি। খুব একটা শুটিং হয় না। কোন কাজ কর্ম নেই, কিছু নেই। কিছু লোক আছে বেকার তারা গিয়ে আড্ডা মারে শুনি। তবে অসুস্থতার কবলে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে সিনেমার সঙ্গে নেই। চেনা জগতটাকে খুব মিস করি।

সর্বশেষ কবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন?
মনে নেই। লাস্ট একটা ছবি করতে ছিলাম বৃদ্ধাশ্রম। তারপর আর ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারি নাই।

অনেক দিন থেকে অসুস্থ। শিল্পী সমিতি থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন? বা খোঁজ খবর রাখে?
হ্যাঁ খোঁজ খবর রাখে। জেনারেল সেক্রেটারি বলেছে কোন অসুবিধা হলে আমাদের জানাবেন। আমি কেউ কে বিষয়টি জানাই নাই। কারন কে কাকে নিয়ে ভাববে? সবাই তো ব্যস্ত। সবাই তো যন্তনার মধ্যে আছে। কেউ ভালো নেই। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে ইচ্ছে আছে আপন ভুবনে ফেরার। এটাই আমার পেশা। এটাই আমি জানি। এটার মধ্যেই আমার প্রান।

এখন অনেক যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে জানেন? কলকাতা ও বাংলাদেশের এক হয়ে কাজ করাটা আপনি কীভাবে দেখেন?
হ্যাঁ জানি। শুনি যৌথ প্রযোজনার ছবি বানানো হচ্ছে রিলিজও হচ্ছে। এটা শুরু হয়েছে অনেক দিন হলো। রেজাল্টটা কি ঠিক বুঝতে পারছি না। এটা কি হচ্ছে শিল্পী বাড়ছে, না প্রযোজনা বাড়ছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। তবে সঠিক নীতিমালা মেনে হলে ভালোই হবে। বন্ধু ভাবাপন্ন দুইটি দেশ। দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময় হওয়া উচিত। হচ্ছেও বোধ হয়। অনেক সময় ফিফটি ফিফটি শিল্পী কলাকশলী নেওয়া হয় না। নীতিমালা মানা হয় না। মানতে গেলে হয়ও না। তবুও হচ্ছে, হোক। ভালো কিছু হোক।

এখনও অভিনয়ে আগ্রহ আছে?
অভিনয়ের জন্য মনটা খুব কাঁদে। যে আমি ঠিকমত মুভমেন্ট করতে পারছি না। অভিনয় করতে পারছি না। যেটার দিকে আমার মন যায় সেটা করতে পারছি না। সমস্ত রক্তে রক্তে মিশে আছে অভিনয়। সেটাই আমি করতে পারছি না। সে দুঃখ আক্ষেপ কাকে জানাবো? সৃষ্টিকর্তা কে জানাই।

এই যে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে চলচ্চিত্র থেকে। এর কারণ কী?
প্রবীর মিত্র : কারণ একাগ্রতা নেই। যে স্ক্রিপ্ট লেখে তারও একাগ্রতা নেই। কোন মতে বম্বে তামিল গল্প কপি করে দিয়ে দেয়। নিজস্ব গল্প বলার কেউরই সময় নেই। অথচ আমাদের নিজস্ব অনেক গল্প বলা যায়।

একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে মাসের পর মাস লাগে তা না করে কোন একটা গল্প কপি করে দিয়ে দিচ্ছে। দুইটা পয়সা পেল এতই খুশি। এটা খুব খারাপ লাগে। এ ভাবে হয় না। একটা স্ক্রিপ্ট ঠিকঠাক তৈরি করতে হবে। তার সংলাপ লাগবে, চিএনাট্য লাগবে ঠিকমত। হচ্ছে কি হচ্ছে না। ব্যাপারটি খুব কঠিন। এটা এত সহজ নয়। কঠিন ব্যাপারটা এত সহজ ভাবে নিলে হবে না। প্রত্যক কে সময় দিতে হবে। কাজটিকে ভালোবাসতে হবে। নকল নিয়ে লাফালে লাভ নেই। অনেকেই বলে থাকেন ৬০-৯০ এর দশকে বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ ছিল।

এখন আর আগের মতো মেধাসম্পন্ন লেখক, পরিচালক, অভিনেতারা চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেই। তখন চলচ্চিত্রের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সবাই সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকতেন। পয়সাটা তখন মুখ্য ছিল না। মুখ্য ছিল ‘কিছু একটা করার চেষ্টা’। তাই অনেক ভালো ভালো চলচ্চিত্র হয়েছিল সে সময়।

অভিনয়ের জন্য কে অনুপ্রোরণা দিয়েছিল?
অনুপ্রোরণা বুঝি না। অভিনয় ভালো লাগত। নাটক করতাম। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। এভাবেই পেশা হিসেবে নেওয়া।

৭৮ বছর বয়সে অভিনয় জীবনের প্রাপ্তি-
এ গুলো হিসেব করতে ভালো লাগে না। কি পাইনি, কি পাইছি এ গুলো হিসেব করতে মন চায় না। অনেক কিছুই পাই নাই, আবার অনেক কিছুই পেয়েছি।
এখনকার সিনেমার গল্প তো নায়ক-নায়িকা নির্ভর এ গুলো ঠিক না। একজনের ছবি মানুষ দেখে না। একটা পারিবারিক গল্প থাকবে। বাবা মা বিভিন্ন চরিএ থাকবে হিরো হিরোইন থাকবে। হিরো হিরোইন নাঁচানাচি গানাগানি করবে এ গুলোতে ছবি চলবে না। একটি সামাজিক গল্প থাকবে সবাই সবার সর্বোচ্চ দিয়ে কাজটি করবে। পরিচালকদের আমি বলতে চাই সুস্থ ভাবে ছবি বানাবেন। সেটা তাড়াহুড়া করলে তো হবে না। কারোরি কোন সিনসিয়ার নেই। সে যেই হোক। টেকনোশিয়ান শিল্পী কেউরই নেই।

এখন নতুন অনেক শিল্পী আসছে, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
আসছে কি-না আমি জানি না। শিল্পী আশা দরকার। শিল্পী আসুক। আসলে পরে এটার উন্নয়ন হবে অবউন্নয়ন হবে সব দিক দিয়ে। কিন্তু আশা করি ভালো কিছু হোক। ইন্ডাস্ট্রি মরে যাবে এটা চাই না। সবাই এটা তুলে ধরুক।

এখনকার বেশিরভাগ শিল্পীদেরই তো মঞ্চের সঙ্গে উল্লেখ করার মতো যোগাযোগ নেই।
এ জন্যই শিল্পী নেই। কারণ মঞ্চটা হচ্ছে প্রধান এবং প্রথম। এখান থেকে শিল্পী আসবে। এখানে অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়। মাসের মাস রিহার্সাল দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। শিল্পী তৈরি হবে মঞ্চ থেকে। সেটাকে উপেক্ষা করলে হবে না

অনেকেই বলা বলি করছে, ঢাকাই চলচ্চিত্রে সিনিয়ার শিল্পীদের চরিএ নিয়ে ভাবা হয় না। এর সত্যতা কতটুকু?
সিনিয়ার শিল্পীদের নিয়ে ভাবা হয় কি-না তা জানি না। প্রয়োজন যদি হয় সেখানে না নিলে মনে কষ্ট পাই। যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিতে হবে। সে যেই হোক। যেখানে যাকে দরকার সেখানে দিতে হবে।

প্রযোজকরা ছবিতে তাদের লগ্নিকৃত টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। তাই সবাই প্রযোজনা থেকে সরে দাড়ায় এ বিষয়ে কি বলবেন?
যার যার পয়েন্ট ভিউতে কাজে আসে। সে অনুযায়ী টাকা লগ্নি করে আবার ফেরতও পায়। অনেকে আবার ফেরত পায় না। না পেলে চলে যাবে এটা স্বাভাবিক। ছবি হিট হলে একটার পর একটা ছবিতে লগ্নি করে।

অনেকে প্রযোজনায় অন্য উদ্দেশ্য আসে।
এ গুলো সব জায়গায় আছে ভালো খারাপ। তবে এখানে একটু বেশি। গ্লামারের জায়গা তাই এখানে অনেকে আসে আনন্দ ফুর্তি করতে। এ রকম কিছু লোক আছে। এদের কে এবাউট করা উচিত। দীর্ঘ ২৮ বছর পর চলচ্চিত্রাঙ্গনে চতুর্থবারের মত আবারও শুরু হয়েছে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতা। অনেকেই বলছেন পুরাতন যারা রয়েছে তারা বেকার কাজ নেই।

নতুন করে বেকার মুখ খোঁজার মানে কি! এ ব্যাপারে কি বলবেন?
এখন যারা এটার উদ্যোক্তা তারা যদি ফিল করে যে নতুন শিল্পী দরকার আছে তাহলে নেবে। তাই বলে পুরানো শিল্পীদের হটিয়ে দিয়ে নিবে তা নয়। পুরতান নতুন থাকবে সবাই মিলে মিশে কাজ করবে। তাহলেই একটা ভালো জিনিস তৈরি হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে