dakghor

ডেস্ক রিপোর্টঃ চিঠি আর ডাকঘর— এখন কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে। বিভিন্ন কারণে মুখ থুবড়ে পড়া ডাক বিভাগকে গুনতে হচ্ছে লোকসানও। অবশ্য ডাক বিভাগ দেখাতে চেষ্টা করছে লাভের মুখ। ১০-১৫ বছর আগেও ডাক বিভাগ ছিল সাজানো-গোছানো ছিমছাম। তার সেই সোনালি জীবন এখন কেবলই অতীত। একটা সময় ছিল, যখন ডাকঘরগুলোয় অনেককে ধরনা দিতে হতো। আর এ প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রায় মৃত অবস্থায় রয়েছে। আগের মতো নেই এর জৌলুস। অথচ আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির দাপটের যুগেও পৃথিবীর বহু দেশে এখনো ডাকঘরনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থাই প্রধান ভূমিকা পালন করে চলছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ডাকঘরকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাতেই অধিক আস্থা নাগরিকদের। বাংলাদেশে সমস্যা ভারাক্রান্ত আর জনপ্রিয়তা হারানো ডাক বিভাগ এখন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।

মানবেতর জীবনযাপন করছেন এখানকার কর্মরত অসংখ্য কর্মচারী। প্রতিটি শাখা ডাকঘরে কর্মচারী রয়েছেন তিনজন করে। এদের মধ্যে একজন ইডিএ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্ট এজেন্ট), একজন ইডিএমসি (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্ট মেইল ক্যারিয়ার) ও একজন ইডিডিএ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্ট ডেলিভারি এজেন্ট)। লোকজনের কাছে ইডিএরা পোস্টমাস্টার এবং ইডিএমসি ও ইডিডিএরা পিয়ন হিসেবেই বেশি পরিচিত। এসব শাখার মধ্যে কোথাও আবার চৌকিদার-ঝাড়ুদারও কর্মরত। মাসের শেষে ইডিএ (পোস্টমাস্টার) ১২৬০ টাকা, ইডিএমসি ১২০০, ইডিডিএ ১১৭০ টাকা এবং চৌকিদার ও ঝাড়ুদাররা পান ৬৭৪ টাকা। ঈদ বা পূজায় তাদের ভাগ্যে কোনো বোনাস জোটে না। পান না সরকারি অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা। অথচ বছরের পর বছর একই পদে অভিন্ন বেতনে অনিশ্চিত অবস্থায় তারা কাজ করে যাচ্ছেন। বছরের পর বছর ধরে এ বৈষম্যের শিকার এখানকার ২৩ হাজার কর্মচারী।

জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে ৯ হাজার ৮৮৬টি ডাকঘর। যার মধ্যে বিভাগীয় ডাকঘরের সংখ্যা ১৪২৬ এবং অবিভাগীয় ডাকঘরের সংখ্যা ৮৪৬০। যেখানে কর্মরত ৩৯ হাজার ৯০৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৮৬ এবং ভাতাপ্রাপ্ত বা অবিভাগীয় কর্মচারীর সংখ্যা ২৩ হাজার ২১ জন। অবিভাগীয় ডাক কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, তাদের যেন একটি জাতীয় স্কেল দেওয়া হয়, নয়তো ভাতার পরিমাণ বর্তমান যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়। কোনোটিই হয়নি, তাই আশার প্রদীপ এখন সবার কাছেই নিভু নিভু। অবশ্য ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এদের এক দফা ভাতা বাড়ানো হয়েছে। সে কথা জানিয়েছেন একাধিক কর্মচারী। তবে ডাক বিভাগ বলছে, ডাক বিভাগের বিদ্যমান নিয়োগ বিধিমালার শর্তানুযায়ী এসব কর্মচারী বা ইডিদের বিভাগীয় কর্মচারী হিসেবে নিয়োগদানের বা সরকারি চাকরিতে স্থায়ীকরণের সুযোগ নেই।

প্রযুক্তির কাছে হার : প্রযুক্তির ধারাক্রম এখন অজপাড়াগাঁয়েও গেছে। তাই এসএমএস, মেইল আর ফেসবুকে চ্যাটই প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। পরিবারের কেউ দেশের বাইরে কিংবা অন্য কোথাও অবস্থান করলে তার খোঁজ নেওয়া হতো চিঠির মাধ্যমে। তাকে বাড়ির ‘অবস্থা’ জানানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল এই চিঠি। তখন মোবাইলের মতো দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। জনপ্রিয় ছিল চিঠি। ২০০৪ সালেও দেশে ২৩ কোটি চিঠি লেনদেন হয়েছে। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাধারণ চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে ৫ কোটি আর ২০১৪-১৫ সালে হয়েছে ৪ কোটি। এভাবেই প্রতিবছর ব্যক্তিগত চিঠির ব্যবহার দিন দিন কমছে। পুরনো দিনের চিঠি আজও প্রবীণ ও মধ্য বয়সীদের জীবন অধ্যায়ের পাতা। একটা সময় ডাকপিয়নেরও কদর ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি বিলি করার নানা মজার ঘটনা এখনো অনেকের স্মৃতিতে অমলিন। অনেক ডাকপিয়ন প্রণয়ঘটিত অনেক বিয়ের নীরব সাক্ষী। পিঠে চিঠির বস্তা নিয়ে ঝুনঝুন ঘণ্টা বাজিয়ে রাতের আঁধারে রানার ছুটত দূরের পথে।

জরাজীর্ণ বেহাল : বেশির ভাগ ডাকঘরের অবস্থা করুণ। জনবলের অভাবে, ভাঙা চেয়ার, টেবিল ও কাঠের বাক্সে, আলমারি দিয়ে কোনোমতে চলছে কার্যক্রম। সরকারি আসবাবপত্রের বরাদ্দ হলেও তা উপজেলা ও শাখা পর্যায়ের ডাকঘরসমূহে এসে পৌঁছায় না। ফলে আসবাবপত্রের অভাব দীর্ঘদিন লেগে থাকে। প্রয়োজনীয় আলমারি না থাকায় অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র যেখানে-সেখানে অরক্ষিতভাবে ফেলে রাখায় তা বিনষ্ট হচ্ছে। গ্রামীণ অনেক ডাকঘর রীতিমতো ভুতুড়ে ভিটেয় পরিণত হয়ে আছে। অথচ বিপন্ন বেহালদশাগ্রস্ত এসব ডাকঘরেও ১১টি মূল সেবাসহ মোট দুই ডজনেরও বেশি সেবা চালু রয়েছে। এসব সেবার মধ্যে রয়েছে— ডাক বিভাগ দেশি-বিদেশি সাধারণ চিঠি, পোস্টকার্ড, রেজিস্ট্রি চিঠি, ডাকটিকিট বিক্রয়, পোস্টাল অর্ডার, মানি অর্ডার, পার্সেল, জিএমই (গ্রান্টেড মেইল এক্সপ্রেস), ইএমএস (এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস), ভিপিপি (ভ্যালু পেবল পার্সেল) ইস্যু ও বিলি, ভিপিএল (ভ্যালু পেবল লেটার), বীমা পার্সেল, স্মারক ডাকটিকিট বিক্রয়, মোবাইল মানি অর্ডার, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, ডাক জীবনবীমা, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম জমা, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে টাকা পাঠানো ও নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রি। এসবের মুষ্টিমেয় কয়েকটি সেবায় গত কয়েক মাস কিছুটা অগ্রগতি থাকলেও ডাক পরিবহনের সবকটি সেবায় গ্রাহক সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। গ্রাহকদের ডাক খোয়া যাওয়া, দেরিতে পাওয়া, পাওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা, অনিশ্চয়তার কারণেই গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন কমছে।

অভ্যন্তরীণ মানি অর্ডারের প্রতিযোগিতায়ও টিকতে পারছে না ডাক বিভাগ। সেবার মান দুর্বল হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক মানি অর্ডার নেমে এসেছে অর্ধেকে। আন্তর্জাতিক মানি অর্ডারের প্রায় ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক। পার্সেল কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। স্ট্যাম্প বিক্রির অবস্থাও বেহাল। ইএমটিএস ও পোস্টাল কার্ড বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও নানা কারণে তা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচার-প্রচারণার অভাবে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ দুটি স্কিমে গ্রাহক বাড়ানো যাচ্ছে না। চালু হচ্ছে না নতুন সুবিধাও। পাসপোর্ট আবেদন চালু হলেও নানা কারণে বিভিন্ন সময় তা বন্ধ থাকছে। বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের স্কিমগুলো সফল হলেও ইদানীং সঞ্চয়ী হিসাব খুলে অর্থ জমা রাখায় গ্রাহকসংখ্যা কমছে। সুদ কম দেওয়ার কারণেই গ্রাহকসংখ্যা কমছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। ডাকঘরের অন্যান্য সেবা কার্যক্রমের মধ্যে ই-ব্যাংকিং, জীবনবীমা, সাধারণ বীমাসহ সরকারি চিঠিপত্র, পার্সেল ইত্যাদি নানামুখী সুবিধা ও কার্যক্রম চালু আছে। তবে এসব কার্যক্রমের মধ্যে ই-ব্যাংকিং সেবা জনসাধারণ ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগায়। প্রাইভেট ই-ব্যাংকিং সুবিধার তুলনায় ডাকঘরে ই-ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করা অনেকটা ভোগান্তিমুক্ত বলেও মনে করেন গ্রাহকরা। ‘দেশজুড়ে নেটওয়ার্ক আছে কিন্তু সেবা নেই’ বাংলাদেশ ডাক বিভাগের বর্তমান কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করলেন এ বিভাগেরই এক কর্মকর্তা। এমনকি ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস), পোস্টাল ক্যাশ কার্ডসহ নতুন নতুন সেবা নিয়েও এগোতে পারছে না এই সংস্থা। উপরন্তু হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিনের এজেন্সিশিপ। ফলে বছর বছর ভারী হচ্ছে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের লোকসান। হিসাব মতে, ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৭০ কোটি টাকা। এখন তা ২৩৪ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

তুলে নেওয়া হচ্ছে রাস্তার পোস্টবক্স : সেই ডাক বিভাগের প্রতি এখন তেমন আগ্রহ নেই এই প্রজন্মের আধুনিক মানুষের। যতটুকু আছে শুধুই দাফতরিক। রাজধানীতে কয়েকটি এলাকা ছাড়া অধিকাংশ জায়গায় গেলেই দেখা যায় চিঠি রাখার বাক্সের চারপাশে আগাছার রাজত্ব। চিঠির সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে কমছে নগরীর রাস্তার ধারের পোস্টবক্সের সংখ্যা। নগরীর মোট ১৪০টি স্পটে বসানো হয়েছিল পোস্টবক্স। এর মধ্যে কোথাও এক আবার কোনো কোনো পয়েন্টে দেশ, জাতীয় ও নগরী এই ক্যাটাগরিভেদে বসানো হয়েছিল তিনটি করে বক্স। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ১১টি স্পটের ডাকবাক্স তুলে নেওয়া হয়। পোস্টবক্সগুলো ভেঙে গেছে বলে তুলে নেওয়া হয়েছে এমনটি জানালেন ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল (ঢাকা সাউথ) কে এম আবুল কালাম আযাদ। বর্তমান সরকার ডাক বিভাগকে গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।

প্রথম পর্যায়ে সাড়ে আট হাজার ডাকঘরে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। এসব ডাকঘর আইটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ ছাড়া ডাক বিভাগের এসএমএস মানি অর্ডার কার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। জানা যায়, প্রবাসীদের অর্থ দেশে পৌঁছানো, মোবাইল ফোনে অর্থ স্থানান্তর, পাসপোর্টের আবেদনপত্র ও অর্থ জমা, সঞ্চয়ী হিসেবে অর্থ জমা রাখা, বাজারে প্রাইজবন্ড ছাড়া, অনুমিত আয়কর জমা, মোটরগাড়ি ও টেলিফোন বিল জমা, রাজস্ব স্ট্যাম্প বিক্রি পোস্ট অফিসের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নিজস্ব পরিবহন সার্ভিস গড়ে তোলার জন্য ১১৮টি গাড়ি কেনা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬ কোটি ৩৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। জাতীয় সংসদে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ডাক বিভাগকে তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিক করা হচ্ছে। পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে ৫ হাজার ৫০৬টি ডাকঘরে ই-সেন্টার চালু করা হয়েছে। ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে ৮ হাজার ৫০০টি ডাকঘরকে ই-সেন্টারে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর গ্রামীণ ডাকঘর নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১৭৩টি আইসিটি বেইজড রুরাল পোস্ট অফিসের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ১৮০টি নতুন টেন্ডার করা হয়েছে।

বি/পি/এন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে