2

বিডি নীয়ালা নিউজ(১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৬) মারুফ সরকার (সিরাজগনজ প্রতিনিধি): কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় শনিবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তাড়াশের দই মেলা। হিন্দু ধর্মের বিদ্যাদেবী শ্রী-পঞ্চমীর স্বরশ্বতী পূজা উপললেক্ষে এ দই মেলার গোড়াপত্তন ঘটে। উত্তর জনপদের বড় জমিদার তাড়াশের রায় পরিবার জমিদার আমলে। ১৯৪৭এর পূর্বে দই মেলার এক চেটিয়া ক্রেতা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। পথঘাটহীণ চলনবিলের মাঝে অবস্থিত তাড়াশ জমিদার বাড়ির অঙ্গনে দইয়ের আমদানীঘটত নৌপথে। বিলের দক্ষিণের তৎকালীন ফরিদপুর থানার ডেমরা, গোপালনগর, ফরিদপুর, চাটমোহর, পূর্বের শাহজাদপুর, বেড়া, উল্লাপাড়া, লাহিড়ী মোহনপুর, সিরাজগঞ্জ থানার সয়বাদাবাদ, রায়গঞ্জ থানার ধানগড়া, পাঙ্গাসী, বিলের পাশ্ববর্তী উত্তরের থানা শেরপুর, ধুনটের হাসুখালি থেকে দই আসতো মানুষে বহন করা ভাড় হয়ে। পশ্চিমে সিংড়ার ডাহিয়া থেকে দই আসতো নৌপথে। জমিদার পরিবার ও দই মেলাকে কেন্দ্র করে তাড়াশে বসতি গড়ে ওঠে কয়েকঘর ষোষ পরিবারের। সে সময় মেলায় দই পৌঁছানোর পরই প্রতি ঘোষ জমিদারকে ভ্যাট দিতো দই। প্রত্যেক ঘোষের দই জমিদার পরিবার ও আমলারা স্বাদ গ্রহণ করার পর পুরস্কার বিতরণ করতো ঘোষের মধ্যে। দইয়ের এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এবং নিজেদের দই তৈরির দক্ষতা প্রমাণ করার জন্যই ঘোষদের দইসহ মেলায়সহ আগমন ঘটতো। তাছাড়া চলনবিলেন তাড়াশ অঞ্চল বছরের অধিকাংশ সময় পানি থাকায় গবাদীপশু সংখ্যা কম থাকায় বছরের একটি দিনেই এলাকার মানুষ দই ক্রয় করতো। ঘোষদের নাম ডাক ছাড়া বেচাকেনা করে লাভবান হতো দই মেলায়। ৪৭’র পর জমিদার পরিবার ভারতে পাড়ি জমান। জমিদারী স্বত্ত্ব বাতিল পর্যন্ত জমিদারের আমলারা দই মেলার তত্ত্বাবধান করতো জমিদারের প্রতিনিধি হিসেবে। যুক্তফন্ট সরকারের আমলে জমিদারী স্বত্ত্ব বিলোপ ঘটায় মেলা পরিচালনায় আসেন স্থানীয় অভিজাত হিন্দুর পরিবারগণ। এসব পরিবারের অধস্তনগণও ভারতে চলে যাওয়ায় এখন মেলা দেখাশুনা করেন মুসলিম সম্প্রদায়ই। অর্ধশত বছর পর্যন্ত দইয়ের প্রতিযোগিতা নেই–নেই পুরস্কার বিতরণেরও প্রথা। তবুও ঘোষেরা মেলার দিকে নাড়ীর টানে দই নিয়ে আসে। এ দইয়ের সিংহভাগ ক্রেতাই তাড়াশ উপজেলার মুসলমানরা। এখন আর চলনবিলে পানি নেই। নৌপথের বিকল্প হয়েছে পাকা রাস্তা। আগের মতো আর দুই-একদিন আগেই তাড়াশে ঘোষদের আসতে হয় না। সাতসকালেই আধুনিক যানবহনে তাড়াশের ঈদগাহ ময়দানে বসে যায় দই মেলা। এ বছরও ৩৫টি দইয়ের স্টল বসেছিলো। মোট দইয়ের আমদানি ছিলো ১শ ২০মণ। সর্বচ্চো মেলায় দই নিয়ে হাজির হয়েছিলো গুরুদাসপুর উপজেলার শ্রীপুরের চানউল্লাহ ঘোষ। তার দইয়ের পরিমান ছিলো ৩০মণ। ৭০ বছর বয়সের এ বৃদ্ধ তাড়াশে দুই মেলায় আসেন ৪৫ বছর যাবত। সে কাজ শিখেছিলো তাজ জেঠা(বড় কাকা) মুসলমান ঘোষ সায়াদ ঘোষের নিকট । দূরদুরান্ত থেকে ঘোষদের দই নিয়ে যারা এসেছিলো তাদের মধ্যে ছিলো ধানগড়ার মহাদেব ঘোষ, কৃষ্ণঘোষ, বিষ্ণ ঘোষ, শ্রীপুরের ফারুক ঘোষ, শেরপুরের বেজি ঘোষের ছেলে নিমাই ঘোষের দই এনেছিলো তার কর্মচারীরা। শেরপুরের উৎগায়ের কামী ঘোষ, তাড়াশের আনন্দ ঘোষ, অধীর ঘোষ, অক্ষয়ঘোষ, রতন ঘোষ, বিরেন ঘোষ, নিরেন ঘোষ, শেরপুরের খানপুর গ্রামের মকশেদ ঘোষ, রায়গঞ্জ উপজেলার কালিঞ্জা গ্রামের জীবন ঘোষ, কার্তিক ঘোষ। এরা সবাই বংশগতভাবে তাড়াশে দই মেলায় অংশ নিয়ে আসছেন। এ বছর সিংড়ার ডাহিয়া, ফরিদপুরের ডেমরার ঘোষেরা দই মেলায় অংশ নেয়নি। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ দই মেলা আগে জমিদাররা দেখভাল করতো এবং উৎসাহ যোগাত। বর্তমানে প্রশাসনযন্ত্র ও কর্মকর্তাগণ দই মেলার দেখভাল না করলেও মেলা বসছে পূর্বের রেশেই। তবে জমিদারদের পুরস্কার বিতরণ প্রথা সরকারিভাবে আবার চালু করলে পুরানো ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের ঘোষের সন্তানরা উৎসাহ পাবে। আরো জমজমাট হবে বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী কয়েকশ’ বছরের পুরনো তাড়াশের দই মেলা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে