………………………মাহফুজার রহমান মণ্ডল

এই সেই চামড়া যা দিয়ে জুতা তৈরি হয় আর তৈরি হয় জ্যাকেট, হাত মোজা, ব্যাগ, মানি ব্যাগ, ওয়ালেট, বেল্ট ইত্যাদি, দেশের চাহিদা মাথায় রেখে উদ্বৃত্তাংশ রপ্তানি করা হয়। শুধু তৈরি জুতা ও পোশাক নয় আধা পাকা ও পাকা চামড়াও বিদেশে বাজারজাত করা হয়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশে আয় হয়েছে ১১৬ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায়  ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। তবে আশাকরি আগামী অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি আয় আরও বাড়বে।

চামড়া নামটা মুখে নিলেই যেন পশুদের চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে আসে, সাড়া বছর ধরে দেশে যে কয়েকটি পশু জবাই হয়, হয়ত দেশের চাহিদা মেটান সম্ভব কিন্তু রপ্তানি চিন্তাটা আসলো কোথা থেকে? নিশ্চয়ই কোরবানির পশুর চামড়ার কথা চলে আসবে। যাইহোক এটা আল্লাহ্‌র রহমত, আর  আমাদের দেশ খুব শীঘ্রই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এটা তার নমুনা।

কিন্তু চামড়ার কাঁচা মাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা পর্যন্ত কয়েকটা ধাপ পার হতে হয় আর এর মধ্যে নানান কাহিনী যেন “কে শুনে কার কথা চৈত্র মাসে বান”।

এই ধরনের একটা ঘটনা নীলফামারী শহরের ট্রাফিক মোড় বড়বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গরুর চামড়া। আর ছাগলের চামড়ার দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অন্যান্য উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও চামড়া বিক্রি করে খুশি নন পাইকাররা। স্থানীয় ব্যবসায়ী হাফিজার রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম এখন কম। আবার লবণের দামও বেশি। এ ছাড়া ট্যানারি মালিকরা চামড়া না কেনার নির্দেশনা দিয়েছে। এটাও বাজারে চামড়ার দাম কমার কারণ হতে পারে।’ নীলফামারী চেম্বারের সভাপতি সফিকুল আলম ডাবলু বলেন, ‘এই চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ চার জায়গায় হাতবদল হয়। প্রথমে মৌসুমি ব্যবসায়ী গ্রাম ঘুরে চামড়া কেনেন। দ্বিতীয় ধাপে পাইকার বা মধ্যস্থতাকারী নগদ টাকা দিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তা কিনে নেন। তৃতীয় ধাপে যায় আড়ৎদারের কাছে। সবার শেষে কেনেন ট্যানারি মালিকরা। এই চার ধাপের মধ্যে আড়ৎদার কিংবা ট্যানারি মালিক লোকসানের মুখে খুব একটা পড়েন না। লোকসান দিতে হয় আগের দুই পক্ষকে।’ (১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ইং, বিডি নীয়ালা নিউজ)

এদিকে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার দমদমা গ্রামের মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী মিজানুর সরদার, আ. জলিল, আইয়ুব হোসেন, আব্দুস ছালামসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা জানান, এখনকার আড়ৎদারেরা পরিকল্পিতভাবে চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কারণে তারা লোকসানের মুখে পড়েছেন। তারা বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্য মোতাবেক গরুর চামড়া ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা হওয়ার কথা সে চামড়া ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র বিশ টাকায়। ছোটখাট খাসির চামড়া বিক্রি হয়নি বলেও মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।(২০১৬-০৯-২১, দৈনিক ইনকিলাব)

  ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ইং ঢাকা টাইম্‌স – এ  বলা হয় ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীর সোতাসী এলাকার রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার অধ্যক্ষ মাওলানা মিজানুর রহমান জানান, ছাগলের চামড়া প্রতিটি ৩০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রয় করতে হয়েছে, অন্যদিকে খুব ভাল গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৬শ থেকে ৮শ টাকায় বিক্রয় করতে হয়েছে।তিনি আরও বলেন, যদি সঠিক দামটি আমরা পেতাম তাহলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক স্বচ্ছলতা ভালো হতো। আরও একপর্যায়ে তিনি বলেন, বাজার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চামড়া সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় লবণ না সরবরাহ থাকায় চামড়ার ব্যবসায় এই ধস নেমেছে।এবার ট্যানারি মালিকদের সংগঠন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন রাজধানীতে লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে বর্গফুটপ্রতি ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে এই দাম ৪০ টাকা। অর্থাৎ লবণছাড়া দাম হওয়ার কথা আরও কম। কিন্তু এই হিসাব ধরে চামড়া কিনতে পারেনি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

এদিকে লবণের সঙ্কটকে দায়ী করে দৈনিক ইত্তেফাক- এর ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ইং তারিখে বলা হয় – কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মেহেরপুরের চামড়া ব্যবসায়ীরা। গেল বছরের চেয়ে দর কমিয়ে দেওয়ায় চামড়া বেচাকেনায় ছন্দপতন দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে লবণ সংকটও। অপরদিকে ট্যানারি মালিকরা বিগত দুই বছরের চামড়া কেনার টাকা পরিশোধ না করায় পুঁজি সংকটে পড়েছেন মেহেরপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এসব সমস্যার কারণে চামড়া বিক্রি ও পুঁজি ফিরে পাওয়া নিয়ে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মেহেরপুরের চামড়া ব্যবসায়ীদের মাঝে।

শুধু লবনের সঙ্কট নয় কোন এক পরিস্তিতিতে লবণের দাম বেড়ে যায় এমন একটি খবর দৈনিক জনকণ্ঠ –এর কণ্ঠে আসে যে,  রাজধানীসহ সারাদেশ থেকেই ট্রাক বোঝাই করে কাঁচা চামড়া আসছে হাজারীবাগ ও লালবাগের পোস্তা এলাকায়। আড়তদাররা চামড়া কিনছেন, লবণজাত করছেন শ্রমিকরা। দুটি স্থানে পুরোদমে চলছে সংরক্ষণ প্রক্রিয়াও। পোস্তার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে, প্রথম দিনেই চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেতে পেরেছেন তারা। তবে, হঠাৎ করেই লবণের দাম বেড়ে যাওয়া এবং শ্রমিক সঙ্কট থাকায় সংরক্ষণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। পোস্তা থেকে চামড়া যাচ্ছে হাজারীবাগে। আবার ঢাকার বাইরে থেকে সরাসরি চামড়া আসছে হাজারীবাগের ট্যানারিতে। সেখানেও তাই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার একই চিত্র। তবে, দ্রুত চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করতে পারলে অন্তত ২৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তাদের। তবে, সরকার নির্ধারিত দামে লবণজাত না করা চামড়া কিনে ফেলায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬)

ট্যানারী মালিকদের কাছ থেকে আগের পাওনা টাকাই কেউ কেউ এখনো পাননি এধরনের অভিযোগ সময়ের কণ্ঠস্বর এভাবে বর্ণীত হয় যে – দিনাজপুর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সাবেক সভাপতি তৈয়ব উদ্দিন চৌধুরী জানান, লোকসানের বোঝা দিন দিন ভারি হওয়ার কারণে প্রবীণ ব্যবসায়িরা এ ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। অনেকেই চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা করছেন। কেউ কেউ এখনো ট্যানারী মালিকদের কাছ থেকে আগের পাওনা টাকাই পাননি। এসবে প্রভাব পড়ে ঈদ এলেই।তিনি বলেন, এবার ঈদে চামড়ার আমদানি কম হওয়ার অন্যতম কারণ ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট। তারা এমন দাম বেঁধে দিয়েছেন যাতে ব্যবসায়ি চামড়া বিমুখ হন। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাচারের পথ প্রসারিত হয়ে আগামীতে চামড়া শিল্প আরো বড় সংকটে পড়বে বলেও জানান তিনি।(প্রকাশঃ ১৪-০৯-২০১৬)

এই ধরনের আরও খবর পাওয়া যায় জাগো নিউজ ২৪-এ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে ব্যবসায়ীদের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। এখনও সেই টাকা পাওয়া যায়নি। অপরদিকে বকেয়া টাকা ফেরত দেয়া লাগবে বিধায় এ বছরের চামড়াও কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না ট্যানারি মালিকরা।(২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬)।

আবার কেউ কেউ নির্ধারিত ফুটের থেকে বেশি দামে কেনেছে এরকম সংবাদ পরিবেশন করেছেন আমাদের সময়.কম –নওগাঁর চাকরাইল আড়ৎদার আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ জানান, হাটে প্রচুর চামড়ার আমদানি হয়েছে। চামড়া কেনার ক্রেতার সংখ্যা কম। যারা আছেন তারা চামড়ার দাম কম বলছেন এবং কম দামে কিনছেন। বড় একটি গরুর চামড়া প্রায় ২০ থেকে ২৪ ফুট হয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা চামড়ার অনুমান বেশি করায় এবং নির্ধারিত ফুটের থেকে বেশি দামে কেনায় কম দামে বিক্রি হওয়ায় তাদের এই লোকসান। (২৬-০৯-২০১৬)

অপরদিকে জেলার প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসায়ীরা ঢাকায় বিক্রি না করতে পেয়ে ঝুঁকি নিয়ে কম দামে চামড়া কিনে মজুদ করছে। ১ সপ্তাহের মধ্যে ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি না করতে পারলে মজুদ চামরা নষ্ট বা পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া লবণের দাম বৃদ্ধির কারণেও প্রক্রিয়াজাত করা চামড়ার খরচও বেড়ে যাচ্ছে।( দৈনিক যায়যায়দিন)

উপরোক্ত বেশির ভাগ পত্রিকা গুলোতে লবণের সঙ্কটকে বার বার দেখানো হয়েছে। আবার লবন থাকলেও চড়া দামে বিক্রয় হয়েছে। তাহলে আমরা ধরে নিব আগের বছরের চেয়ে এবার পশু বেশি কোরবানি হয়েছে।

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, দৈনিক ভোরের পাতায়  লবণের সঙ্কট আর থাকবে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে লবণের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে। ঈদের আগে দেড় লাখ টন লবণ আমদানি করা হয়েছে। ঈদের তিন দিন আগে আরও এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

যাইহোক এবার তাহলে লবণের সঙ্কট আর থাকবে না কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ী, পাইকার বা মধ্যস্থতাকারী এনাদের কি হবে? এনারা কি এদের ন্যায্য মূল্য ফিরে পাবে?

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,(০৯-০৯-২০১৬) বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন শুক্রবার সকালে ঢাকার ধানমন্ডির এক রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেন- “ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া কিনবেন ৫০ টাকায়; ঢাকার বাইরে এর দাম হবে ৪০ টাকা।এছাড়া সারা দেশে খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫ টাকায় সংগ্রহ করা হবে।“

যদি তাই হয় তাহলে মৌসুমি ব্যবসায়ী, পাইকার বা মধ্যস্থতাকারীরা কিছুটা স্বস্থি পাবেন। আর উনারা স্বস্থি পেলে সাধারণ জনগণও স্বস্থি পাবেন। তবে স্বস্থি পাওয়াটা যেন নিশ্চিত হয় এটা কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের আকুল আবেদন থাকবে। আগামী বছরে যেন লবণের সঙ্কট না থাকে সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া ও সঠিক মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করতে পারে তা নিশ্চিত করা, তা না হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণের অবহেলার কারনে চামড়া সংগ্রহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে আর এই মূল্যবান সম্পদ পচে নষ্ট হতে পারে, এতে আগামী অর্থবছর গুলোতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হ্রাস পাবে আর হ্রাস পাবে বাংলাদেশের আয়ের খাত গুলোর একটি খাত।

তাই সম্মলিত চেষ্টায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে, শুধু চামড়া নয়, কাঁচামাল হিসেবে পাট, তুলা, চা, শাকসবজি ইত্যাদি পণ্যদ্রবের দিকে নজর দিয়ে তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষে কাজ করতে হবে। তবে আমাদের দেশ খুব শীঘ্রই একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে যা বিশ্বের মানচিত্রে আর এক বাংলাদেশ গর্জে উঠবে।

 

লেখক– কলামিষ্ট, সম্পাদক ও কবি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে