ডেস্ক রিপোর্টঃ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) দুর্নীতির ১৯টি উৎস চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক গঠিত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এসব দুর্নীতি বন্ধে আট দফা সুপারিশও করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বিমান ক্রয় ও লিজ নেওয়া, রক্ষণাবেক্ষণ, টিকিট বিক্রি, কার্গোতে আমদানি-রপ্তানি, ক্যাটারিং খাতসহ আটটি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে বেবিচকের ক্রয় খাত, সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ, কনসালট্যান্ট নিয়োগ, বিমানবন্দরের স্পেস/স্টল ও বিলবোর্ড ভাড়া, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজসহ ১১টি খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে ১১টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে।

দুদকের কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান গতকাল রবিবার সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রী দুদকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘শুধু দুর্নীতি নয়, যারা কাজে অবহেলা করবে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিবাজের স্থান নেই।’

ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, বেবিচকে দুর্নীতির ১১টি উৎস চিহ্নিত করার পাশাপাশি এসব প্রতিরোধে ১১টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে।

দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে দুর্নীতির আটটি উৎস উল্লেখ করে কোন খাতে কিভাবে দুর্নীতি হয় সে সম্পর্কেও বলা হয়েছে।

ক্রয় ও লিজ : বিমান, বিমানের স্পেয়ার্স, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্টস ক্রয় ও লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়ে থাকে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও বিমানের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার নামে মধ্যস্বত্বভোগী ফার্ম ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কতিপয় বোর্ড ডিরেক্টরকে অনৈতিকভাবে কনভিন্স করে পরস্পর যোগসাজশে মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়।

রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহলিং : বিমান এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ অতি উচ্চমূল্যে ক্রয় দেখিয়ে ঠিকাদার ও ম্যানুফ্যাকচারার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে এই অপকর্ম চলে।

গ্রাউন্ড সার্ভিস : দুর্নীতির অন্যতম খাত হলো গ্রাউন্ড সার্ভিস ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অধিক মূল্যে নিম্নমানের ইকুইপমেন্ট কেনা। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণের মূল্যবান উপকরণাদি বিক্রি করে হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা।

কার্গো এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট : কার্গোসেবায় সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কোটি কোটি টাকা এয়ারওয়ে বিল কম পাচ্ছে বিমান। আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের ওজন ও ভলিয়ম রেকর্ডভিত্তিক কম দেখিয়েও বেশি পরিমাণ মালামাল বিমানে ওঠানো হয়। এই অতিরিক্ত টাকা আমদানি-রপ্তানিকারকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয় সিন্ডিকেট।

যাত্রী : ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার ও লে-ওভার প্যাসেঞ্জারের হিসাব এদিক-সেদিক করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে সিন্ডিকেট। ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি দেখিয়ে খাবারের বিল করে অতিরিক্ত টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। লে-ওভার প্যাসেঞ্জারদের জন্য নিয়ম অনুযায়ী হোটেলের প্রতি রুমে একজন রাখার কথা। কিন্তু বাস্তবে প্রতি রুমে চার-পাঁচজন রাখা হয়। আর বিল তৈরি করা হয় জনপ্রতি।

অতিরিক্ত ব্যাগেজ চার্জ : অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি চার্জ নিলেও তা মূল্য হিসাবে না দেখিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। অন্যদিকে যাত্রীদের বুকিং ট্যাগ ও ফ্লাইট ডিটেইলে অতিরিক্ত ওজন দেখানো হয় না।

টিকিট বিক্রি : প্রায়ই বাংলাদেশ বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। অথচ বাস্তবে বিমানের আসন খালি যায়। এ ক্ষেত্রে যোগসাজশ করে বেসরকারি এয়ারলাইনসকে বেশি টিকিট বিক্রির সুবিধা করে দেওয়া হয়। বিনিময়ে বিমানের কর্মকর্তারা পান মোটা অঙ্কের কমিশন।

ক্যাটারিং : নিম্নমানের খাবারের কারণে দেশি-বিদেশি অনেক এয়ারলাইনস বিএফসিসি থেকে খাবার নেয় না। এর ফলে শুধু বিএফসিসি খাতেই বিমান কোটি কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বেবিচকে দুর্নীতির উৎস হিসেবে ১১টি খাত উল্লেখ করা হয়েছে।

ক্রয় : সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন ক্রয়ে টেন্ডারের স্পেসিফিকেশন ও প্রাক্কলন প্রি-ডিফাইন করিয়ে নেয় ঠিকাদাররা। এভাবে তারা কাজ পেয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ : বেবিচকের বেশির ভাগ প্রকৌশলীর বিদেশে একাধিক বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। কাগজপত্র ঠিক রেখে যেনতেনভাবে নিম্নমানের কাজ করে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা : প্রচুর সম্পত্তি অবৈধ দখলে থাকলেও দখলদারদের সঙ্গে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের কারণে নিয়মতান্ত্রিক উচ্ছেদসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আর গোপনে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে মাসোয়ারা আদায় করেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।

বিমানবন্দরের স্পেস/স্টল ও বিলবোর্ড ভাড়া : সম্পত্তি শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মালিকানায় বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে ব্যাঙের ছাতার মতো টং দোকান গড়ে উঠেছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে মানানসই নয়।

কনসালট্যান্ট নিয়োগ : উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকৃত অভিজ্ঞ কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয় না। এতে কনসালট্যান্টদের বেতন-ভাতাদিতে বেবিচকের আর্থিক ব্যয় হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না।

বিদেশে প্রশিক্ষণ : প্রায় প্রতি মাসেই বিদেশে একাধিক প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকেন কর্মকর্তারা এবং এসব ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কাজে আসে না।

মন্ট্রিল কনভেনশন বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা : মন্ট্রিল কনভেনশন বাস্তবায়ন না করায় একদিকে যাত্রীরা অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। 

মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ : প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। আর এভাবে মেইনটেন্যান্স কাজে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়।

এয়ারক্রাফটের লাইসেন্স প্রদান : লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে অসাধু কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সংস্থার শর্তাদি পরিপালন না করে প্রাইভেট এয়ারক্রাফটের লাইসেন্স প্রদান করেন, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি ও শিডিউল অনুমোদন : টাকার বিনিময়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারের অনাপত্তি না নিয়েই এয়ারলাইনসগুলোকে নতুন ফ্রিকোয়েন্সি/শিডিউল অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। আর এতে এয়ারলাইনাররা তাদের পছন্দমতো সময়ে শিডিউল পেয়ে থাকে।

অপারেশনাল কার্যক্রম : প্রশাসনিক কাজে মারাত্মক সমন্বয়হীনতা যাত্রী দুর্ভোগকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ক্যাটাগরি-২-এ অবস্থান করছে। ফলে সরাসরি দেশের বিমান যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারছে না।

K/K/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে