ডেস্ক রিপোর্টঃ রং লেগেছে প্রকৃতিতে। গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় ম ম সৌরভ। ফুলে ফুলে বসন্তবউরির আনাগোনা, কোকিলের কুহুতান জানান দিল বসন্ত এসে গেছে।

গ্রাম, শহর সব জায়গায় রঙের ছোঁয়া। গ্রামের চেয়ে বসন্তবরণের উচ্ছ্বাস নগরেই বেশি। গ্রামের নবীন ফুল শহরের হাটে এসেছে। ভোরের আলো ফোটার পরপরই হাট থেকে মানুষের সাজসজ্জায় জড়িয়ে গেছে বাগানের, মাঠের ফুল। রমণীর, তরুণীর কালো খোঁপার মাঝে ফুল হয়ে উঠেছে ফাগুনের অনন্যসুন্দরের প্রকাশ। কারো কাছে বন্ধুর, প্রিয়জনের জন্য শুভেচ্ছার ফুল হয়ে উঠেছে বনের ফুল। সব ফুলই অন্য এক সৌরভে ভরিয়ে তুলেছিল চারদিক। চরণে চরণে পথ চলতে চলতে অন্য এক ভালোবাসায় হারিয়েছে উচ্ছ্বসিত মানুষ।

গতকাল বুধবার ফাল্গুনের প্রথম দিনে রাজধানীসহ সারা দেশে বাসন্তী রং ছড়িয়ে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করেছে মানুষ। বাসন্তী রঙের ছোঁয়ায় প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসার। তার রেশ কিন্তু কাটেনি। কেননা আজ বৃহস্পতিবার যে ভালোবাসা দিবস (ভ্যালেনটাইনস ডে), সে বার্তা এসে গেছে দুয়ারে দুয়ারে।

পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতির অংশ হলেও উদার ও বহুমাত্রিক বাঙালি নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিজেদের মতো করে দিবসটি উদ্‌যাপন করে। বাংলাদেশেও আরেকটি উৎসবের দিন এটি। আজও ফুলের হাটে, রঙিন কার্ডের লেখায়, উপহারে ঘটবে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নেবে আর দেবে, মিলবে আর মেলাবে—এই মেলবন্ধনে, সম্প্রীতির সুর বাজবে রাজধানীসহ দেশজুড়ে।

অনেকের ধারণা, প্রাচীন রোমে রোমান দেব-দেবীর রানী জুনোর সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন পালিত হতো। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত।

২৬৯ সালে ইটালির রোম নগরীতে সাধু ভ্যালেনটাইন নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রি ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দি করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দি অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সাধু ভ্যালেনটাইনের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাঁকে প্রাণদণ্ড দেন। যেদিন প্রাণদণ্ড কার্যকর হয় সেই দিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।

‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়’—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের মতোই বসন্তের প্রথম দিনে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। বাঁশির সুর, গান ও নৃত্যে তাই ঋতুরাজকে বরণ করতে গতকাল ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই উচ্ছল তারুণ্য পোশাকে বাসন্তী রং ছড়িয়ে সমবেত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায়। ছিল নানা বয়সী নারী-পুরুষ। বসন্ত উৎসবে মেতে ওঠে সবাই।

‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ প্রতিপাদ্যে এই উৎসবের আয়োজন করে ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদ’। ভোরের আলো উঁকি দিতেই গিটারের মূর্ছনায় শাস্ত্রীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় বসন্ত উৎসবের উদ্বোধনী পর্ব। এরপর একে একে পরিবেশন করা হয় গান, আবৃত্তি ও নৃত্য। দর্শনার্থীর পদচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে চারুকলা প্রাঙ্গণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিফতু রহমান বলছিলেন, বসন্ত নামটির সঙ্গেই একটা উৎসবের ভাব রয়েছে। এটি বাঙালিকে উৎসবে মেতে উঠতে শেখায়।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উৎসবের রঙে শামিল হন শাহরিয়ার হোসেন। কোলে পাঁচ বছরের শাওলীন সেতুকে নিয়ে এসেছিলেন শাহরিয়ার। কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাঙালির নিজস্ব উৎসব এটি। প্রতিবছর উৎসবে বাচ্চাকে নিয়ে আসি, যেন ছোটবেলা থেকেই বাঙালির উৎসব সম্পর্কে জেনে পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে ওঠে, সেই ভাবনা থেকেই এখানে তাকে নিয়ে আসা।’

জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের যে সংস্কৃতি রয়েছে সেই সংস্কৃতি যেন আমরা সবাই মিলে পালন করি। সেই কারণেই প্রতিবছর বকুলতলায় বসন্ত উৎসব পালন করা হয়।’

বিকেল সাড়ে ৩টায় বকুলতলায় উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। বকুলতলা ছাড়াও বসন্ত উৎসবের রং ছড়িয়েছে পুরো ক্যাম্পাসে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চে একযোগে বসন্ত বরণ করা হয়।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করে বসন্ত উৎসব-১৪২৫। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘মুক্ত মঞ্চে’ অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকেল ৫টায়। উৎসবে ‘আজি কমল মুকুল দল খুলিল, দুলিল বসন্তে বসন্তে তোমায়’ এবং ‘আজ খেলা ভাঙার খেলা’ গানের কথায় সমবেত সংগীত পরিবেশন করে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ ঢাকা মহানগর শাখা। এ ছাড়া সংগীত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীতশিল্পীরা। সমবেত সংগীত পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বাউলদল।

K/K/N.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে