………………………………মাহফুজার রহমান মন্ডল

শিশুরা জন্মায় বিধাতার লিলায়, মানুষ করার দায়িত্ব বাবা-মায়ের, পিতা-মাতা যেন তাদের এক ধরনের চাকরও বটে। সেই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে লালন-পালন আর বিয়া হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব তাদের পিছু ছাড়ে না। সেই দায়িত্বের একটু রেস রয়ে গেলে সন্তানটি কি মানুষ হতে পারে? আমাদের সমাজে দেখা যায় কম বেশি ঘর বেঁধে রয়েছে এরকম হাজার পরিবার কিন্তু সমস্যাতো লেগেই আছে। হতে পারে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিন্তু এটা বেঁচে থাকার তাগিদে। দেশের শান্তি প্রিয় মানুষগুলো যখন দু’মুটো ভাত মুখে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত তখন সুখে থাকা মানুষগুলো কি বুঝতে পারে না তাদের ব্যথা। আর ধর্মটা কি এত সহজ  যে মুখে বললাম এমনি হয়ে গেল, তাও আবার ইসলাম ধর্ম। যে ধর্মের নাম মুখে নিলেই শান্তি মিলে তাঁকে কুলসিত করার অধিকার কারও নেই।

যাই হোক গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি ও শোলাকিয়ায়  পর পর দু’টি ঘটনা ঘটে গেল যেখানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও প্রাইভেট বিশ্ববিদলায়ে পড়ুয়া ছাত্র  জঙ্গি তৎপরতা চালায় ।  সামনে যে আর এ ধরনের ঘটবে না তার গ্যারান্টি কি? তাই দেশের প্রধান মন্ত্রী থেকে শুরুকরে মন্ত্রী, এমপি, রাজনিতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষকবৃন্দসহ সর্বস্থরের মানুষের মুখে মুখে পারিবারিক সচেতনতার স্লোগান শোভা পাচ্ছে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও পত্রিকার পাতাগুলোতে শোভা পাচ্ছে সেই বিজ্ঞগণদের উক্তি –

বিডি নীয়ালা নিউজ(০৮/০৭/১৬)-এ,  প্রকাশিত খবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিভাবকদের প্রতি আহবান “কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নিখোঁজ ছেলেদের সম্পর্কে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানান।“ তিনি বলেন, অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, নিখোঁজ সন্তানদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিন। আমরা তাদের খুঁজে বের করতে এবং প্রয়োজনে তাদের চিকিৎসা দিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেব। বৃহস্পতিবার গণভবনে সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে তিনি এই আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ প্রতিদিন(০৪/০৭/২০১৬)-এ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও তার তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন ‘বাস্তবতা এটি যে, এই সন্ত্রাসীরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। এমন আরও অনেক আছে। এরা আপনার প্রতিবেশী হতে পারে, আত্মীয় হতে পারে, ছেলে হতে পারে। আমাদের দেশকে নিরাপদ রাখবার জন্য আমাদের প্রত্যেককে সতর্ক প্রহরার দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্মের নামে মিথ্যে বলে আমাদের যুব সমাজের মগজ ধোলাই এর প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে জরুরী। একাজে আমাদেরকে একতাবদ্ধ হতে হবে’ ।

এনটিভি বিডিডটকম(০৮/০৭/১৬) –এ, আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘যাদের সন্তানই এই বিপথে গেছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ এসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে তার পিতামাতা কোন মতাদর্শের অনুসারী, সেটা কারো কাছে বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। আমি এ জন্য অনুরোধ জানাব সমস্ত পিতামাতা অভিভাবকদের, যে সন্তানরা কোথায় যায়, কী করে এবং তাদের মনন বিকাশের ক্ষেত্রে যেন আমরা যত্নবান হই।

প্রথম আলো(জুলাই ০৭/০৭/২০১৬)-এ, মুসল্লিদের উদ্দেশে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে, তাদের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। জঙ্গি গোষ্ঠী ধর্মকে কলুষিত করছে। আপনার সন্তানদের খোঁজখবর রাখুন। আপনার সন্তান কার সঙ্গে চলাফেরা করে সেদিকে নজর দিন। সামাজিকভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদের প্রতিহত করতে হবে।’

শীর্ষ নিউজ(০৫/০৭/২০১৬)-এ, ধরনের ঘটনার মূলোৎপাটন করার আহ্বান জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমাদের পরিবারের ভেতরেও এখন আমরা নিরাপদ নই। আমার পরিবারের সদস্য কে কোন দিকে কী কাণ্ড করে ফেলতে পারে।’
‘যে ছেলে মুরগি জবাই করতে ভয় পাবার কথা, সে নির্বিঘ্নে মানুষ জবাই করছে। এই প্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হলো তা চিহ্নিত করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারব না’, যোগ করেন ইউনূস।
গুলশানে হামলাকারীদের মতো আরো কত ছেলেমেয়ে এই প্রক্রিয়ায় আছে তা আমরা জানি না উল্লেখ করে পরস্পরকে দোষারোপ না করে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে চেষ্টার আহ্বান জানান এই নোবেলজয়ী।

যুগান্তর(০৪ জুলাই, ২০১৬)-এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, আগে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ত। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পেছনে দরিদ্রতা একটা অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। কিন্তু এখন যেটি হচ্ছে তাকে এক ধরনের ‘ভ্রান্তিবিলাস’ বলা যেতে পারে। কারণ উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানরা যখন সহজেই সবকিছু পেয়ে যায় বা তার সব চাওয়াগুলোই পূর্ণ হয়ে যায় তখন তার এসব পাওয়ার সুখ এক ধরনের অসুখে রূপান্তরিত হয়। অদ্ভুত এই অসুখই উচ্চবিত্ত তরুণদের জঙ্গি মতাদর্শের দিকে ঠেলে দেয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পারিবারিক মেলবন্ধন তৈরি করতে পারলে সন্তানদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। এজন্য প্রতিটি পিতা-মাতাকে সন্তানদের বেড়ে ওঠা ও তার সঙ্গী সাথীদের ওপর সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। পরিবারে জবাবদিহিতার একটা সংস্কৃতিও বজায় রাখতে হবে। লাগামহীন যথেচ্ছাচার চলাফেরা করলে পরিবারে শাস্তি পেতে হবে এমন একটা মানসিকতা সন্তানদের মধ্যে তৈরি করতে হবে। অভিভাবকদের প্রতি তার পরামর্শ হচ্ছে- ‘আপনার সন্তানটি হঠাৎ একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল কিনা সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে তাকে কাউন্সিলিং করান।’

রাইজিংবিডি ডট কম(০৭/০৭/১৬।)-এ, দেশের অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে ইমামরা বলেন, ‘ইসলামের নামে কোমলমতি ছেলেদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আপনারা সন্তানের চোখে চোখে রাখুন। সে বিপথগামি হচ্ছে কিনা সতর্ক থাকুন। প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সাহায্য নিন। যাতে তারা কোনোভাবেই জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়াতে না পারে।’

বাংলামেইল ডট কম(০৩/০৭/২০১৬)–এ সালমা লুনা(অধিকারকর্মী)মুক্ত মতে বলেনঃআসুন, আমরা মায়েরা জেগে উঠি” –এখানে বলা হয়েছে,

কোনো ইংলিশ বা বাংলা মিডিয়াম স্কুল, কোনো পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এসব শেখাতে পারবে না আমাদের সন্তানদের। এটা কেবল একজন মা-ই পারে। দেশের যা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে ঘরে ঘরে প্রতিটি মাকেই সচেতন হতে হবে। আগে তো ঘর!

বাংলা ট্রিবিউন (০৫/০৭/২০১৬)-এ প্রভাষ আমিন, অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ; মুক্ত মতে বলেনঃ “এবার নজর দিতে হবে ঘরে” গুলশান অভিযানের পর একটা জিনিস পরিষ্কার- জঙ্গিদের খুঁজতে শুধু মাদ্রাসায় বা পাহাড়ে-পর্বতে যাওয়ার দিন শেষ। ঘরে বসে নিশ্চিন্তে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়ার দিনও শেষ। আমাদের এখন ঘরে ঘরে খুঁজতে হবে। নিবরাস, রোহান, আন্দালিব, মোবাশ্বিররা আমাদের চারপাশেই থাকে। তাদের ফেসবুক প্রোফাইল দেখলে, তাদের টাইমলাইন ঘুরলে পরিচিত মনে হয়। আমাদের চারপাশেই তাদের বাস। আমাদের কারও কারও হয়তো পরিচিতও। আমার ছেলে পড়াশোনায় ভালো, ভালো স্কুলে পড়ে, কোনও বদভ্যাস নেই- এটুকু দেখে মধ্যবিত্তসুলভ নিশ্চিন্তে ঢেকুর তোলার দিন শেষ। মাদ্রাসার পাশাপাশি এখন নজর দিতে হবে আমাদের ঘরেই।

উপরোক্ত বিজ্ঞগণদের আলোচনায় আমাদের আর বুঝার বাকি নেই যে, পরিবারের কর্তারাই পারেন সিংহভাগ সমস্যার সমাধান করতে। তবে সমাজের কর্তাদের বিষয়টি এরিয়ে গেলে চলবে না। এতে বলা যেতে পারে স্কুল ও কলেজের শিক্ষকগণের উপদেশ যেন যথাযথভাবে প্রয়োগ হয় এ বিষয়ে গার্ডিয়ানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক ও গার্ডিয়ানদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। নিম্নে দু’জন গার্ডিয়ানের উক্তি প্রকাশ না করে পারলাম না।

সমকাল(০৬/০৭/২০১৬)-এ সামিহ মোবাশ্বিরের বাবা মীর হায়াত কবীর আরও জানান, মুসলিম পরিবারের সন্তান সামিহ সবসময় ধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। পরিবার কখনও তার ধর্মবিশ্বাসকে নিরুৎসাহিত করতো না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করা ছেলে যেন ইসলামের ব্যাপারে বিকৃত ধারণা না পায় সে ব্যাপারে তার বাবার সচেতনতাও ছিল। তিনি সামিহকে পবিত্র কোরআনের ইংরেজি সংস্করণ দিয়েছিলেন এই বিবেচনায় যে সেখানে বিকৃত ব্যাখ্যা থাকবে না। বাবা চাইতেন, ছেলে অন্য কোনও জায়গার বিকৃত ব্যাখ্যা থেকে প্রভাবিত না হয়ে যেন সরাসরি ইসলামের মতবাদ নিজেই অনুসন্ধান করে নিতে পারে। নিজের বিশ্বাস নিজেই গড়ে তুলতে পারে। ছেলে জঙ্গিদের কাতারে নাম লিখিয়ে এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডে অংশ নেবে তা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না বাবা মীর হায়াত কবীর। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বার বার তিনি বলছিলেন- ‘ও আমার ছেলে হতে পারে না। আমি যদি জানতাম ও সেখানে যাচ্ছে তবে জীবন দিয়ে হলেও তাকে থামাতাম।’

কালের কণ্ঠ অনলাইন (৫ জুলাই, ২০১৬)-এ রোহান ইবনে ইমতিয়াজের বাবা এসএম ইমতিয়াজ খান বাবুল বলেছেন, এটা খুবই দুঃখজনক, কষ্টকর এবং বিব্রতকর। ফেসবুক ও টিভিতে জানতে পারলাম, যে আমার ছেলে জড়িত। আমি একজন ব্যর্থ পিতা। আমি আপনাদের মাধ্যমে সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

এবার আমরা জঙ্গি হতে চাই না আর জঙ্গি হতে দিব না তাহলে আমাদের করনীয় কি? উপরোক্ত আলোচনা থেকে বার বার একটি কথাই “পারিবারিক সচেতনা” আর এটাকে ফলপ্রসূ করতে গেলে সন্তানদের চোখে চোখে রাখা। যেমনঃ বিনা প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার না করা, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রয়োজন হলে ব্যবহার করা নচেৎ অন্য উপায়ে তাদের প্রয়োজন মেটানো। একটি শিশুকে ছোট বেলায় যেভাবে স্কুলে আনা-নেয়া করতেন সেভাবে করতে থাকুন। মোবাইল ফোন হাতে তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।এছাড়া পরিবারের অন্যদের সাথে আপনার সন্তানদের নিয়ে আলোচনা করুন। প্রয়োজনে আবাধ্য সন্তানদের ক্ষেত্রে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নিন।

 

লেখক- কবি, কলামিস্ট ও সম্পাদক 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে