……………………….মোঃ আব্দুল মান্নান
দেশের উত্তরাঞ্চলের লোকগীতির রুপ হলো ভাওয়াইয়া গান। এ গান দেশ ও বিদেশে জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পরিবর্তিত হয়ে এখন নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ তার কণ্ঠস্বর দিয়ে একে অপরকে আকর্ষণ করার জন্য স্বরযোগে যে মনোহর ধ্বনির প্রয়োগ করে এবং চর্চার মাধ্যমে উৎকর্ষ লাভ করে, আর এভাবেই জন্ম দেয় এক অনন্য শিল্পসঙ্গীতের। যা মানুষের হৃদয়ের অনুভূতির রসপূর্ণ সুরেলা স্ফুর্তি। আর এটাই হলো এ অঞ্চলের মানুষের আশা আকাংখার, আনন্দ-বেদনার, সুখ-দুঃখ জীবনবাদী ও জীবনমূখিতার গীতিময় প্রতিচ্ছবি, যা হলো ভাওয়াইয়া গান, যা সাধারনের কাছে লোকগীতি হিসেবে পরিচিত। আমরা সচরাচর আয়নায় আমাদের মুখচ্ছবি দেখি, এই লোকগীতি(ভাওয়াইয়া) তেমনি লোক সাধারনের দেখার আয়না; যে আয়না লোক সাধারনের হৃদয় ক্ষরণ, হৃদয়ের অনুভূতি, হৃদয়ের জ্বালা-যন্ত্রণা, বেচে থাকার বাসনা।
মূলত ভাওয়াইয়া গান হচ্ছে গারস্থজীবন তথা শ্রমজীবি মানুষের মনের কথার সহজ ও সরল সুরেরই কাব্যরূপ; যেখানে দৃষ্টি নিবন্ধণ করলে দর্শনার্থী দেখতে পায় দেশ-কাল, সমাজ-সংস্কৃতির হাজার বছরের প্রতিচ্ছবি অর্থ্যাৎ তাদের জীবন সংগ্রামের প্রকৃত পরিচয়। নিজ নিজ এলাকার ভাষায় সাঁজিয়ে ছন্দবদ্ধভাবে প্রকাশিত আকুতি প্রকাশই হলো এ অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গান। সহজ ভাষায় জনগণের জন্য স্বতঃ প্রণোদিতভাবে লিখিত স্ব-প্রণোদিত সুরে মুখেমুখে প্রচারিত গানই হলো ভাওয়াইয়া গান।
নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলায় এগানের অনেক নাম যশা শিল্পী রয়েছে। এদের মধ্যে পরলোকগত মহেশ চন্দ্র রায়; যাকে এ ভাওয়াইয়া গানের প্রাণ পুরুষ বলা হয়। তিনি এ উপজেলার পুঁটিমারী গ্রামের সন্তান। নানা চড়াই উৎরাইয়ের পরও যিনি গ্রামীণ লোকসঙ্গীতের সংস্কৃতিকে জাগ্রত করে রেখেছেন কিশোরগঞ্জ উপজেলা ও দেশ থেকে বিদেশে। তার লেখা ভাওয়াইয়া গান নিজকন্ঠে, নিজসুরে গেয়ে আজও সবার মাঝে নিজেকে খ্যাতিমান হিসেবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তার মত আরও একজন শিল্পী মরহুম আশরাফ আলী(ইসলা)। যার কন্ঠের ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতি গান শুনে মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত। যারা তার গান শুনেছেন তাদের নিকট থেকে কৃতিমান এ শিল্পীর প্রশংসা শোনা যায়। তিনি কিশোরগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের উত্তর পূষণা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। গারাগ্রাম উত্তরপাড়া গ্রামের প্রয়াত সংসারু ছিলেন একজন সুমধুর কন্ঠের গায়ক , যারা তার গান শুনেছেন তারা তার আজও প্রশংসা করেন। তিনিও প্রায় পনের বছর আগে মারা গেছেন। রথীন্দ্রনাথ পোদ্দার ডাকনাম মিষ্টুদা। তিনি রংপুর বেতারের নিয়মিত ভাওয়াইয়া শিল্পী ছিলেন। তিনি প্রায় ৫০ বছর আগে ভারতে চলে গেছেন এবং সেখানে বসবাস করছেন। এ উপজেলায় নাম না জানা আরো অনেক লোক শিল্পী ছিলেন; যারা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন।
একসময় দেশে ফকিরী গানের খুব জনপ্রিয়তা ছিল। কিশোরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের রুপালী কেশবা গ্রামের মডেল প্রাইমারী স্কুল এলাকার বাসিন্দা ছিলেন মরহুম আমির উদ্দিন অরফে আমদ্দী গীদাল। যার নাম এখনও অনেক প্রবীণ মানুষের মুখে শোনা যায়। আমির উদ্দিন এক নাগারে এক মাস পর্যন্ত একই মঞ্চে একই গান করতেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। কালের বিবর্তনে এ শিল্পীর নাম এখন অনেকেই জানেন না। ভাওয়াইয়া ও পল্লীগান সহ ফকিরী গানের কিছু শিল্পীর নামের কথা উপরে উল্লেখ করলাম। কিন্তু গানের শিল্পী ছাড়াও এ উপজেলায় ছিলেন অনেক নাট্য ও যাত্রা শিল্পী। আগে এ উপজেলায় প্রায় প্রতি গ্রামে যাত্রাগানের আসর বসতো। অনুষ্ঠিত নাটকের ও ঝুমুর যাত্রাগান যেগুলোর কোন মঞ্চ ছিল না, মাটিতে মঞ্চ বানিয়ে গোল হয়ে সবাই একসঙ্গে বসে এ যাত্রাগানের অভিনয় করতো। ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে অভিনয় করা হত। এলাকার মাতাব্বরের উঠানে এ আসর বসতো। গ্রামীণ অভিনয় শৈলীতে তারা সাধারণ মানুষের মন জয় করত, আনন্দ দিত। এ যাত্রা গানগুলোর নাম ছিল, “পেচুয়ারী, তুফান চেয়ারম্যান, চৌদ্দ সাধু, মাইয়া বন্ধক থোয়া” ইত্যাদি নামে এসব যাত্রাপালা গ্রাম বাংলার মানুষের মনের খোরাক যোগাত। এ গান গুলো এখন আর হয় না, এগুলো অনেক অতীত; বর্তমান প্রজন্ম এসবের কিছুই জানেনা।
শীতের মৌসুমে প্রায় প্রতি এলাকায় নাটক মঞ্চ হত। নবাব সিরাজুদ্দৌলা, টিপু সুলতান, নীল দর্পণ, একটি পয়সা, সিঁদুর নিওনা মুছে ইত্যাদি। এগুলো যারা অভিনয় করত তারা ছিল এলাকার নন্দিত শিল্পী। বর্তমানে এখন আর এগুলো হয় না। সবাই এখন আকাশ সংস্কৃতিতে ঝুকে পরেছে।
খ্যাতিমান এসব নাট্যশিল্পীরা হলেন, মরহুম ডাঃ আব্দুল কুদ্দুস, সতীশ চন্দ্র মোহন্ত, ক্ষিতিশ চন্দ্র মিস্টুদা, সামসুর রহমান মন্টু, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, মনোরাদন দ্বিবেদী, আঃ সোবহান, আব্দুল মাজেদ, অহেদুল ইসলাম, বাবুল, কনকচন্দ্র, আশুতোষ ঠাকুর, হৃদয় বাবু, সিরাজুল ইসলাম ও আঃ আউয়াল।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার সংস্কৃতিকে যারা এখনও লালন করছেন এরা হলেন, মোঃ আনছার আলী, আব্দুল মান্নান, সুবল চন্দ্র, মাহাদুল ইসলাম, হৃদয় বাবু, হীরেন্দ্র নাথ রায়, আব্দুল হামিদ মাষ্টার, গোলাম রসুল রিপন, হাসানুজ্জামান ভূট্টু, নালু ঠাকুর। এরাও এখন বয়সের ভারে আক্রান্ত। নুতন প্রজন্মের মধ্যে লক্ষীরাণী প্রেমা, পুতুল রাণী, রায়হানসহ অনেকে।
তবে স্বাধীনতা পরবর্তী ৮/১০ বছর পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের শিল্প, সংস্কৃতি ও লোক সংস্কৃতির চর্চা যেভাবে হত এখন তা আর হয় না। আকাশ সংস্কৃতি যেন এখনকার আদি সংস্কৃতি ভাওয়াইয়া গানসহ সমস্ত লোকগীতি ও লোক সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটিয়ে ফেলেছে। আগামীতে হয়ত এ অঞ্চলের ঐতিহ্য ভাওয়াইয়া গান ও স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর নির্মিত যাত্রা, ঝুমুর যাত্রা, নাটকসহ সবকিছু কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে বলে সংস্কৃতি প্রেমীদের ধারণা। এখানকার গ্রামীণ সংস্কৃতি, গান, নাটক, যাত্রাপালা, ঝুমুর যাত্রাসহ সমস্ত লোক সংস্কৃতি রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া না হলে আগামীতে এগুলোর চর্চা আসতে আসতে বিলুপ্ত হতে পারে। সরকারী কিংবা বেসরকারী পর্যায়ে এগুলো সংরক্ষণে তাই উদ্যোগ নেয়া জরুরী।
……………..লেখক ও সাংবাদিক





